তুলা অর্থকারী ফসলের মধ্যে অন্যতম। আমাদের দেশে সাধারণত শীতকালে তুলার চাষ করা হয়। কিন্তু বর্তমানে কোথাও কোথাও গ্রীষ্মকালেও তুলার চাষ করছে। আমাদের দেশে দুই ধরণের তুলার চাষ করা হয়। সমতল এলাকার ৭টি জোনে সমভূমির তুলা বা আপল্যান্ড কটন এবং পার্বত্য এলাকার ২টি জোনে পাহাড়ি তুলার চাষ করা হয়।
তুলা রোপণের সময়
পাহাড়ি তুলা এপ্রিল-মে মাসে এবং সমভূমির তুলা জুলাই-আগস্ট মাসে বপন করা উত্তম। পাহাড়ি তুলা ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে এবং সমভূমির তুলা জানুয়ারি-মার্চ মাসে উত্তোলন করা হয়।
তুলার জাত
আমাদের দেশে দেশি-বিদেশি বেশ কয়েক প্রকার তুলার জাত রয়েছে। তার মধ্যে-সিবি-৫, সিবি-৯ সিবি-১০ ও সিবি-১১ প্রভৃতি উচ্চফলনশীল জাতের তুলা এবং হাইব্রিড জাতের মধ্যে হীরা হাইব্রিড রূপালী-১ ও ডিএম-১ জাতের তুলা। এ ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে পাহাড়ি তুলা-১ ও পাহাড়ি তুলা-২ নামে উচ্চফলনশীল জাতের তুলা চাষ হয়।
তুলা চাষে জমি তৈরি
তুলা চাষের জমি ভাল করে কয়েক বার চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে ও সমান করে নিতে হবে। এসময় জমিতে আগাছা থাকলে পরিষ্কার করে নিতে হবে।
তুলা চাষে রোপণ পদ্ধতি
জমিতে রস কম থাকলে বপনের পূর্বে বীজতুলা ৩/৪ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে বপন করা ভাল৷ উল্লেখ্য, বপনের সময় লাইনে পাতলা করে অনবরত বীজ দিয়ে পরবর্তীতে চূড়ান্ত ভাবে চারা পাতলা করে গাছ থেকে গাছের দুরত্ব ৭-৮ সেমিঃ এর মধ্যে রাখতে হবে।
তুলার রোগসমূহ
(১) চারা গাছের রোগ
(২) ফিউজেরিয়াম উইল্ট বা ঢলে পড়া রোগ
(৩) পাতায় দাগ পড়া রোগ
(৪) ব্যাকটেরিয়াল ব্লাইট রোগ
(৫) বোল পঁচা রোগ
(৬) এ্যানথ্রাকনোজ রোগ
(৭) শিকড় পঁচা রোগ
ক্ষতির ধরণ অনুসারে তুলা ফসলের অনিষ্টকারী পোকা-মাকড়কে প্রধানত: দু´শ্রেণীতে ভাগ করা যায়৷ যথা- (ক) শোষক ও (খ) চর্বনকারী পোকা৷
শোষক পোকা
যেসব পোকা-মাকড় গাছের কচিপাতা, ডগা, কুঁড়ি, ফুল ইত্যাদি অংশ থেকে রস শোষণ করে গাছের সমূহ ক্ষতিসাধন করে থাকে তাদেরকে শোষক পোকা বলা হয়৷ তুলার প্রধান প্রধান শোষক পোকার নাম দেয়া হলো-
(১) জ্যাসিড
(২) জাব পোকা
(৩) লাল গান্ধি পোকা
(৪) সাদা মাছি
(৫) থ্রিপস
(৬) লাল মাকড়সা
চর্বনকারি পোকা
এ পোকাগুলো গাছের মূল, পাতা, ফুল, কুঁড়ি চর্বন করে এবং ডগা বা বোল ছিদ্র করে ভিতরে প্রবেশ করে ক্ষতিসাধন করে থাকে৷ এই পোকা সাধারণত: শুককীট অবস্থায় গাছের ক্ষতি করে থাকে৷ এ ধরণের ক্ষতিকারক পোকাগুলো হলো-
১.গুটি পোকা
২.আচা পোকা
৩.পাতামোড়ানোপোক
৪.কাটু পোকা
তুলা ক্ষেতের কয়েকটি উপকারী পোকা মাকড়
১) মাকড়সা
২) লেডিবার্ড বিটল
৩) সিরফিড ফ্লাই
৪) ড্রাগন ফ্লাই
৫) ড্যামসেল ফ্লাই
৬) গ্রীন লেস উইং
৭) ইয়ার উইগ
৮) রোববিটল/স্ট্যাফিলিনিড
রোগ-বালাই ও পোকামাকড় দমন
বিভিন্ন পদ্ধতিতে তুলা ক্ষেতের রোগ ও ক্ষতিকর পোকামাকড় দমন করা যায়। এর মধ্যে যান্ত্রিক পদ্ধতি উল্লেখযোগ্য-
১. আলোর ফাঁদ ব্যবহার করা ৷
২. পাখি বসার জন্য ক্ষেতের মাঝে বাঁশের কঞ্চি, গাছের ডাল ইত্যাদি পুঁতে দেয়া ৷
৩. গামলায় ১:৯ অনুপাতে কেরোসিন ও পানি মিশিয়ে লাল গান্ধি পোকা চুবিয়ে মারা৷
৪. শোষক পোকা যেমন-জ্যাসিড, এফিড ও সাদামাছিকে তুলার ক্ষেত থেকে দুর করার জন্য প্রতি
৫. লিটার পানিতে ২০-২৫ গ্রাম গুঁড়া সাবান মিশিয়ে স্প্রে করলে পাতায় সাবানের একটা হালকা আবরণ তৈরি হবে তাতে শোষক রস শোষণে অনীহা দেখাবে৷
৬. ১ কেজি ঝোলা গুড়ের সংগে ৩০ গ্রাম এসাটাফ অথবা ৫-১০ গ্রাম একতারা ভালভাবে মিশিয়ে
৭. কমপক্ষে ১০ টা ফাঁদ তৈরী করে ১ বিঘা জমিতে ব্যবহার করা যায়৷ গুড়ের গন্ধে বোলওয়ার্মের ৮. মথ আকৃষ্ট হবে এবং খাওয়ার পর বিষক্রিয়ায় মারা যাবে৷
৯. হাত বা পা দ্বারা পিষে ডিম ও কীড়া নষ্ট করা৷
হলুদ ফাঁদ
একটি হলুদ বা কমলা রংয়ের কাপড় বা বোর্ডে মোবিল লাগিয়ে ক্ষেতে স্থাপন করলে সাদা মাছি হলুদ বা কমলা রংয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ছুটে আসে এবং মোবিলে আটকে মারা যায়৷ কয়েকদিন ব্যবহারের পর কাপড় বা বোর্ডটি পরিস্কার করে পুনরায় ব্যবহার করা যায়৷
তুলার ব্যবহার
বীজ তুলা হতে ৩৫-৪০% আঁশ ও ৬০-৬৫% তুলা বীজ পাওয়া যায়। তুলার আঁশ বস্ত্রকলগুলোতে সুতা তৈরির প্রধান কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বর্জ্য তুলা (গার্মেন্ট শিল্প ও জুট) লেপ-তোষক ও শীতরঞ্চি তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়। তুলা বীজ হতে তেল ও খৈল পাওয়া যায়। তুলাবীজ থেকে প্রাপ্ত পরিশোধিত তেল ভোজ্যতেল ও অপরিশোধিত তেল সাবান তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তুলা বীজের খৈল গবাদিপশু ও মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বীজের গায়ে লেগে থাকা আঁশ পৃথক করার পর এগুলো ব্যান্ডেজ, গজ, ব্লটিং পেপার এবং কটন বাড প্রভৃতি তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়।
তুলার সাথে সাথী ফসল চাষ
তুলার সাথে সাথী ফসল হিসেবে বিভিন্ন শাকসবজি যেমন- লালশাক, ডাঁটাশাক, মুলাশাক, বরবটি, মুলা, শসা, বাঁধাকপি, ফুলকপি, ধনেপাতা ইত্যাদি চাষ করা হচ্ছে। রিলে ক্রপ হিসেবে আদা, হলুদ, মরিচ, পটল, আখ ইত্যাদি ফসলের সাথে তুলা চাষ করা যায়। বিভিন্ন ফল বাগান যেমন- কলা, পেঁপে, আনারস, আম বাগানে প্রতি বছর আন্তঃফসল হিসেবে তুলা চাষ করা হয়।
Leave a Reply