বেশি লাভের আশায় মৌসুম শুরুর আগেই ৬০ শতক জমিতে তরমুজ চাষ করেছিলেন কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের শীলখালীর কৃষক আজিজ উল্লাহ। চাষাবাদে খরচ হয় ১ লাখ ৫ হাজার টাকার মতো। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার বেশ ভালো ফলন হয়েছে। ফলন দেখে আশায় ছিলেন অন্তত চার লাখ টাকা লাভ হবে। তবে সে আশায় গুড়েবালি। লাখ দেড়েক টাকা লাভ নিয়েই সন্তুষ্ট হতে হচ্ছে তাঁকে।
চাষি আজিজ উল্লাহ জানান, প্রতিবছর ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকারেরা টেকনাফে এসে তরমুজ কিনে নিয়ে যান। কিন্তু ট্রাকভাড়া বেড়ে যাওয়ায় এ বছর জেলার বাইরের কোনো এলাকা থেকে ক্রেতারা তেমন একটা আসছেন না। স্থানীয় তরমুজ ব্যবসায়ীরা তেমন একটা দাম দিতে চান না। জেলার বাইরের ক্রেতারা টেকনাফে এলে অন্তত তিন থেকে চার লাখ টাকা লাভ হতো।
আজিজ উল্লাহর মতো এবার আগাম তরমুজের ভালো ফলনে বাড়তি আয়ের স্বপ্ন দেখেছিলেন বেশির ভাগ চাষি। ট্রাকভাড়া বেড়ে যাওয়ায় তাঁদের প্রায় সবার স্বপ্ন এখন ফিকে হয়ে গেছে। মোহাম্মদ আবসার নামের উপজেলার ওয়াবপ্রিয়া এলাকার এক চাষি জানান, তিন মাস আগে তিনি এক কানি (৪০ শতক) জমিতে চাষ শুরু করেন। খেত থেকে এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকার তরমুজ বিক্রি করতে পেরেছেন। অনেক তরমুজ বিক্রি করতে না পেরে খেতে পচে গেছে। এখন খেতে যে পরিমাণ তরমুজ আছে, তা বিক্রি করে বড়জোর লাখখানেক টাকা পাওয়া যাবে। তুলনামূলক কম ফলন হওয়ার পরও গত বছর ওই খেত থেকে আড়াই লাখ টাকার তরমুজ বিক্রি করেছিলেন বলে দাবি তাঁর।
গতকাল শনিবার বেলা ১১টার দিকে টেকনাফ পৌরসভার বাসস্টেশন মোড় ও দুপুর সাড়ে ১২টায় পৌরসভার অলিয়াবাদ ও বাস টার্মিনাল এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, থরে থরে তরমুজ সাজিয়ে রাখা হয়েছে ফুটপাত ও আড়তগুলোতে। তবে ক্রেতার সংখ্যা খুবই কম। যাঁরা এসেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই একটি-দুটি করে তরমুজ কিনে নিচ্ছেন।
বিক্রেতারা জানান, উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় খেতে গিয়ে চাষিদের কাছ থেকে এসব তরমুজ বিক্রির জন্য নিয়ে এসেছেন তাঁরা। বেশির ভাগই খুচরা ক্রেতা তাঁদের কাছে আসছেন। পাইকার দু-একজন মিললেও তা জেলা শহর ও এর আশপাশের এলাকার।
পৌরসভার বাসস্টেশন মোড়ে তরমুজ বিক্রি করতে দেখা যায় টেকনাফ সদর ইউনিয়নের নতুন পল্লানপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ শাহজাহানকে। তিনি বলেন, খুচরা বিক্রির ওপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণে অনেক সময় বিক্রি করতে না পেরে বাজারেই তরমুজ পচে যাচ্ছে। এতে তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
এরপরও তরমুজচাষিরা লাভবান হচ্ছেন বলে মনে করছেন উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. শফিউল আলম কুতুবী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ট্রাকভাড়ার প্রভাবে ক্রেতা কমায় বিক্রি কমেছে, এটা সত্য। তবে কাউকে ক্ষতির মুখে পড়তে হয়নি।
বাজারে তরমুজ কিনতে আসা জেলা শহরের পাইকারি ব্যবসায়ী জাকির হোসেন বলেন, একদিকে পরিবহন ভাড়া বেশি, এর ওপর কৃষকদের বাড়তি খরচের কথা বলে বেশি দাম রাখছেন আড়তদারেরা। তাই পাইকারেরা তরমুজ কিনতে আগ্রহ হারাচ্ছেন। এ ছাড়া শীতের প্রভাবে বাজারে চাহিদা কিছুটা কম বলে দাবি তাঁর।
জাকির হোসেন বলেন, ৫০৫টি তরমুজ তিনি ৭৫ হাজার টাকায় কিনেছেন। ছোট-বড় প্রতিটি তরমুজের দাম পড়েছে ১৪৮ টাকার বেশি। এর সঙ্গে পরিবহনভাড়া যুক্ত হলে বিক্রি করে খুব একটা লাভ হবে না তাঁর।
স্থানীয় তরমুজ বিক্রেতারা বলছেন, গত বছর টেকনাফ থেকে চট্টগ্রামের ট্রাকভাড়া ছিল ১৪ হাজার টাকা। এ বছর তা ৭ হাজার টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার টাকায়। একইভাবে ঢাকার ভাড়া ৩২ হাজারের পরিবর্তে ৮ হাজার টাকা বেড়ে হয়েছে ৪০ হাজার টাকা। এর বাইরে সিরিয়ালের নামে আরও অতিরিক্ত তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা দালালেরা আদায় করেন। এ অবস্থায় ঢাকা ও চট্টগ্রামের পাইকারেরা টেকনাফে তরমুজ কিনতে আসছেন না। পাইকারেরা আসলে কৃষকদের পাশাপাশি স্থানীয় বিক্রেতারাও লাভবান হতেন।
একাধিক ট্রাকচালক বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করতে গিয়ে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। টেকনাফের লবণ মাঠ ও স্থলবন্দরের পণ্য পরিবহন করেও তাঁরা একই হারে ভাড়া আদায় করছেন।
বর্ষার শেষ দিক থেকেই পাহাড়ি ঢালু জমি, পানের বরজ ও সমুদ্রের তীর ঘেঁষে আগাম তরমুজের চাষ করা হয়। অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জাকিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গত বছর টেকনাফে ৩৬০ জন চাষি ৯০ হেক্টর জমিতে তরমুজের চাষ করেছিলেন। এবার আরও প্রায় ৮ হেক্টর বেশি জমিতে চাষাবাদ হয়েছে। আগাম তরমুজ চাষে লাভ বেশি হওয়ায় চাষিদের উৎসাহ দিন দিন বাড়ছে। সূত্র : প্রথম আলো
Leave a Reply