বিশ্বের ৮৮তম দেশ হিসেবে কার্বোফুরান নামের বালাইনাশক নিষিদ্ধ ঘোষণা করল বাংলাদেশ। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর চিহ্নিত করে গত ১৮ জানুয়ারি এটি নিষিদ্ধ করে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে জারি হওয়া ওই গেজেট আগামী জুন মাস থেকে এটির আমদানি, ব্যবহার ও উৎপাদন বন্ধ থাকবে।
সাধারণত ধান, গম, ভুট্টার মতো দানাদার শস্যের পোকা দমনে কার্বোফুরান ব্যবহার করা হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্লান্ট প্রটেকশন বিভাগ সূত্র বলছে, দেশে ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রায় ৪২ হাজার টন বালাইনাশক ব্যবহৃত হয়েছে। এর মধ্যে আট থেকে দশ হাজার টন হচ্ছে কার্বোফুরান–জাতীয়। দেশে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত বালাইনাশক এটি।
গত বুধবার সরকারের বালাইনাশকবিষয়ক সরকারি স্টিয়ারিং কমিটির সভায় কার্বোফুরান নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে আলোচনা হয়। সেখানে কয়েকটি কোম্পানি চলতি বছরের শেষ পর্যন্ত বালাইনাশকটি বিক্রি ও আমদানির জন্য সরকারকে অনুরোধ করে। তবে দেশে কার্বোফুরানের কারণে মানুষ ও অন্য প্রাণীর ক্ষতি বাড়ছে উল্লেখ করে সময় না বাড়ানোর পক্ষে মত দেন কমিটির সদস্যরা। তাঁরা বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত, নেপাল ও বিশ্বের বেশির ভাগ কৃষিপ্রধান দেশে এটি নিষিদ্ধ হয়েছে।
এর আগে ২০১৬ সালেও কার্বোফুরান নিষিদ্ধের ব্যাপারে আলোচনা উঠেছিল। তবে কয়েকটি বালাইনাশক কোম্পানির চাপে তা পিছিয়ে যায়। সর্বশেষ ২০২২ সালে বিটাকের (বাংলাদেশ শিল্প কারিগরি সহায়তা কেন্দ্র) সভায় এটি নিষিদ্ধের ব্যপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। অবশ্য কোনো প্রজ্ঞাপন জারি না হওয়ায় এর বিক্রি ও উৎপাদন অব্যাহত থাকে।
বিটাকের সভাপতি ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) চেয়ারম্যান শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে কার্বোফুরান নিষিদ্ধ করেছে। আমরাও দেশের মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর হিসেবে প্রমাণ পাওয়ায় বালাইনাশকটি নিষিদ্ধ করেছি।’
২০১৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর বালাইনাশকের একটি তালিকা করে। তাতে কার্বোফুরান বা কার্বোমেট–জাতীয় বালাইনাশককে মারাত্মক ক্ষতিকর (এক্সট্রিমলি হেজারডাস) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ’৯০–এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র ও নিউজিল্যান্ড বালাইনাশকটি নিষিদ্ধ করে। তবে দামে কম হওয়ায় ও পোকা দমনে ভালো কাজ করায় উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এর ব্যবহার চলতে থাকে। ডব্লিউএইচওর প্রতিবেদন প্রকাশের পর এসব দেশ বালাইনাশকটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বালাইনাশক গবেষক মুহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন প্রধান বলেন, কার্বোফুরানের কারণে কৃষক নিজে তো ক্ষতিগ্রস্ত হতোই; একই সঙ্গে তা ভোক্তার জন্য দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি বয়ে আনে। এটি মানুষের শরীরে নিশ্বাস ও খাদ্যের মাধ্যমে প্রবেশ করলে প্রাথমিকভাবে বমি ও ত্বকের সমস্যা হতে পারে। দীর্ঘ মেয়াদে তা কিডনি, ফুসফুস থেকে শুরু করে রক্তে পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে ক্ষতি করে থাকে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সূত্রমতে, দেশে ২৫২টি কোম্পানি কার্বোফুরান আমদানি, বিক্রি ও প্রক্রিয়াজাত করে। দেশের মাটি, পানি ও প্রাণীর জন্য এই বালাইনাশকটিকে সবচেয়ে ক্ষতিকর হিসেবে মনে করা হয়ে থাকে। কারণ, দানাদারজাতীয় ওই বালানাইশক স্প্রে করা হয় না। এটি মূলত ভেজা মাটিতে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ফলে উদ্ভিদের শিকড় দিয়ে পাতা, ডাল ও শস্যের মধ্যে প্রবেশ করে। অন্যান্য বালাইনাশক সাধারণত প্রয়োগের পর ৫ থেকে ২০ দিন তা উদ্ভিদে থাকে। কিন্তু কার্বোফুরান থাকে ৩০ থেকে ৬০ দিন। ফলে ফসল তোলার পর তা ভোক্তার হাতেও পৌঁছে যায়।
বাংলাদেশ কীটতত্ত্ব সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক রুহুল আমীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটি মানুষের জন্য ক্ষতিকর তো বটেই, গাছের পরাগায়ণের ভূমিকা রাখা বিভিন্ন জাতের মাছি, প্রজাপতি থেকে শুরু করে ক্ষতিকর পোকা খেয়ে প্রকৃতির ভারসাম্য রেখে চলা লেডি বিটল ও টাইগার বিটলের মতো পোকা এর কারণে মারা যায়। এটি মাটির উপকারী ব্যাকটেরিয়া ও কেঁচো এবং মাছের ক্ষতি করে। ফলে এই বালাইনাশকের ব্যবহার বাড়ানোর সময় বাড়ানো কোনোভাবেই ঠিক হবে না।
সূত্র :প্রথম আলো
Leave a Reply