কথাগুলো বলছিলেন ষাটোর্ধ্ব কৃষক মফিজুল ইসলাম। থাকেন রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার তিস্তা নদীবেষ্টিত চর ইছলি গ্রামে। নিজের ভিটেমাটি বলতে মফিজুলের তেমন কিছু নেই। ভাঙা-গড়ার খেলায় তিস্তায় বেশ কয়েকবার নদীগর্ভে ঘরবাড়ি হারিয়েছেন। এখন চরের বুকে তোলা দুটো খড়ের ঘর, আর পরের জমিতে চাষাবাদ করা ফসলই তার সম্পদ। এ কারণে বৃদ্ধ বয়সেও হাড়ভাঙা পরিশ্রম করছেন তিনি।
আরেক কৃষক হাসেম আলী। তিনি নিজের উৎপাদিত সবজি বিক্রি করতে স্থানীয় একটি বাজারে তুলছেন। রসুন ও পেঁয়াজের পাশাপাশি সাথী ফসল হিসেবে বিভিন্ন ধরনের সবজির আবাদ করেছেন। চলতি মৌসুমে গঙ্গাচড়ার মহিপুর চরে দুই বিঘা জমিতে রসুন ও পেঁয়াজের পাশাপাশি এক একর জমিতে আলুও আবাদ করেছেন।
মফিজুল আর হাসেম আলীর মতো হাজারো কৃষকের এখন দম ফেলার ফুরসত নেই। তিস্তার বিভিন্ন চরে আলু, রসুন, মরিচ, পেঁয়াজ, ভুট্টা, শশা ও মিষ্টি কুমড়াসহ নানা ধরনের ফসলের পরিচর্যা চলছে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। যেসব ফসল একটু আগাম রোপণ করা হয়েছে, এখন সেগুলো তোলা হচ্ছে বাজারে।
নদীর বুকে জেগে ওঠা বিশাল চর ঘিরে কৃষকের ব্যস্ততা শুধু রংপুরেই নয়, এই মৌসুমে ব্যস্ততা বেড়েছে চরকেন্দ্রিক নদী তীরবর্তী এলাকাগুলোতেও। তিস্তা, ধরলা, ঘাঘট, ব্রহ্মপুত্র, দুধকুমার, করতোয়া, যমুনেশ্বরীসহ অসংখ্য নদ-নদী বিধৌত উত্তরের চরগুলো এখন ‘হিডেন ডায়মন্ড’। প্রতি বছর এসব চরে উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকার ফসল।
শুধু ফসল উৎপাদনেই থেমে নেই চরাঞ্চলের কৃষকরা। বছরে ২৫ লাখ গবাদিপশুর যোগানও দিচ্ছেন তারা। তবে আকস্মিক বন্যা, খরাসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রায় সময়ই তাদের হোঁচট খেতে হয়। সেই সঙ্গে অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য থেকেও বঞ্চিত হতে হচ্ছে চরের কৃষকদের।
ভারত থেকে বাংলায় বহমান তিস্তাকে বলা হয় উত্তরের জীবনরেখা। মাস চারেক আগেও এই নদী ছিল পানিতে টইটুম্বুর। এখন পানি নেই, নৌকার পাল তুলে নেই মাঝির হাঁকডাকও। পানিশূন্য তিস্তার বুকে জেগে উঠেছে চর। আর এসব চরে ফসল ফলিয়ে খাদ্যের যোগান দিয়ে নিরব বিপ্লব ঘটিয়ে যাচ্ছেন মফিজুল-হাসেমের মতো কৃষকরা।
চলছে মাঘের ক্রান্তিকাল, আসছে বসন্তময় ফাল্গুন। তবুও চরাঞ্চলে ভোরটা যেন কুয়াশাময়। আছে শীতের হালকা কাঁপুনিও। এই শীতের সকালে চর ইছলিতে নিজের জমিতে স্বামী-সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে ব্যস্ত আরজিনা বেগম। ২০ শতাংশ জমিতে আবাদ করেছেন রসুন আর পেঁয়াজ।
আরজিনা বেগম বলেন, ‘কষ্ট না করলে খামো কি? হামার তো সারাবছর কষ্ট। নুন আনতে পন্তা ফুরি যায়। এবার জিনিসপাতির দাম বাড়ছে। মাইনসের কাছোত কিছু টাকা ধার (ঋণ) করছি বাহে। তাকে দিয়্যা খিরা (শশা), রসুন আর পেঁয়াজ করছি। এ্যালাতো সার, বীজের দাম বেশি। ভাগ্যিস হামাক কামলা নেওয়া লাগে না। তা না হইলে খরচ আরও বেশি নাগিল হয়।’
গঙ্গাচড়ার চর চল্লিশা গ্রামের একটি চরে আলু তুলছেন মুমিন ও সাত্তার। বিকেলের আগে শহরে পৌঁছানোর তাড়া তাদের। মূল সড়ক থেকে এই চরের দূরত্ব প্রায় ৭ কিলোমিটার। চরাঞ্চলগুলোতে পণ্য পরিবহনের জন্য সাধারণত ঘোড়ার গাড়ি, ঠেলাগাড়ি, গরুর গাড়ি এবং বাইসাইকেল ব্যবহার করেন চাষিরা। চরের বাসিন্দাদের অভিযোগ- দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে প্রায় সময়ই উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন তারা।
কৃষক আব্দুল মতিন বলেন, আমরা কষ্ট করে ফসল তুলে হাটে নিই, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মূল্য পাই না। বেশির ভাগ কৃষকের একই অবস্থা। আমাদের এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব বেশি ভালো না। যদি পাইকাররা একেবারে জমি থেকে ফসল কিনতে পারত, তাহলে আমরা বেশি উপকৃত হতাম। কিন্তু মূল সড়কটি ছাড়া আমাদের চর এলাকার কমবেশি সবগুলো সড়কই গ্রামীণ অবকাঠামোয় গড়া। এ কারণে দূর-দূরান্তের ব্যবসায়ী ও পাইকারদের কষ্ট করে এত দূরে আসতে অনীহা। ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আমরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা থেকে বছরের পর বছর কষ্ট করে যাচ্ছি।
তিস্তায় ভিটেমাটি হারানো শত শত মানুষ এখন ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছেন। আর্থিক সচ্ছলতা ফিরতে শুরু করেছে তিস্তা নদীর চরাঞ্চলের প্রতিটি ঘরে। খরস্রোত নদীর চরের এখন সব দিকটাই সবুজপ্রান্তর। এই মৌসুমে উত্তরের চরগুলোতে বেড়েছে চাষাবাদ। রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রামসহ পুরো উত্তর জনপদে কৃষি বিপ্লবের অন্যতম হাতিয়ার নদীর বুকে জেগে ওঠা চরের আবাদি ফসল।
জানা গেছে, নীলফামারীর ডিমলা উপজেলায় নদীবেষ্টিত চর ২ হাজার ৯৪৫ হেক্টর আর জলঢাকায় ৩২৮ হেক্টর। ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার ঝুনাগাছ চাপানী, খালিশা চাপানী, টেপাখড়িবাড়ী, পূর্ব ছাতনাই, গোলমুন্ডা, ডাউয়াবাড়ী ও শোলমারী ইউনিয়নে তিস্তার ছোট-বড় প্রায় ২৩টি চর আছে। এসব চরের বেশির ভাগ বালুর বুকে সুখের দোল খাচ্ছে সবুজের ফলন।
একই চিত্র লালমনিরহাটে। এই জেলার সদর, আদিতমারী, কালীগঞ্জ, হাতিবান্ধা ও পাটগ্রাম উপজেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তিস্তার বিস্তীর্ণ চরে চাষিরা ফলাচ্ছেন সোনার ফসল। এখানকার চরাঞ্চলের সবজির প্রাচুর্য দেখে যে কারও চোখ জুড়াবে। ফসলের বাম্পার ফলনের সফলতায় হাসি ফুটেছে কৃষকের ঘরে ঘরে।
লালমনিরহাট সদর উপজেলার তিস্তার চরবেষ্টিত খুনিয়াগাছ এলাকার বাসিন্দা মহুবর আলী বলেন, গত বছর এগুলো জমিতে পানি ছিল। এ বছর চর পড়ছে। আমি এবার ৪ বিঘা জমিতে মিষ্টি কুমড়া চাষ করছি। পাশেই তিস্তার ছোট ছোট নালায় পানি আছে। ওখান থেকে পানি এনে গাছের গোড়ায় দেই। ফসল ভালো হয়েছে। আল্লাহ দিলে এবার লাভ হবে।
একই এলাকার নুরু মন্ডল বলেন, এই চরে আমাদের ভাগ্য বদলে গেছে। বন্যা মৌসুমে আমাদের দুর্ভোগে থাকতে হয়। তখন আমাদের কষ্ট বোঝানোর মতো কাউকে খুঁজে পাই না। কেউ সাহায্য করে না। এই মৌসুমে তিস্তায় অনেক বেশি চর পড়েছে। আমাদের জমিগুলো চরে ভেসে উঠেছে। এটা আমাদের মতো গরিবের জন্য আল্লাহর রহমত ও ভালোবাসা। এবার আমরা চর থেকে অনেক লাভবান হতে পারব।
লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, তিস্তার বুকে এ বছর চরের পরিমাণ ১০ হাজার ৮০০ হেক্টর। যার মধ্যে ৮ হাজার হেক্টর জমিতে ফসলের চাষাবাদ হয়েছে। যা গত বছরের তুলনায় ৫০০ হেক্টর বেশি। ফসল ভালো হওয়ার পাশাপাশি কাঙ্ক্ষিত বাজার মূল্য থাকলে তিস্তার চর থেকে কৃষকরা পাবেন ২৯২ কোটি ১৫ লাখ ৫৬ হাজার ১৩৭ টাকা। এই মৌসুমে তিস্তার চরে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার ফসল চাষাবাদ হবে।
এ ব্যাপারে লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক হামিদুর রহমান জানান, গত বছরের তুলনায় এ বছর তিস্তার চরে বেশি চাষাবাদ হয়েছে। ফসলও অনেকটা ভালো হয়েছে। চরের জমি চাষে, চাষিদের নিয়মিত পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। চলছে আবাদের প্লট প্রদর্শনী। সেই সঙ্গে বিভিন্ন প্রকল্পে থেকে চাষিদের পুনর্বাসনের চেষ্টা করা হচ্ছে।
নদী গবেষক ও উন্নয়ন বিশ্লেষকরা বলছেন, কৃষিজমি কমতে থাকায় চরগুলোই দেশের ভবিষ্যৎ খাদ্যের যোগানের কেন্দ্রবিন্দু। তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শফিয়ার রহমান বলেন, নদী শাসনের মধ্য দিয়ে চরগুলোতে সুরঙ্গ করা গেলে দেশের কৃষিতে বড় অবদান রাখা সম্ভব। একই সঙ্গে বৈশ্বিক এই সংকটে খাদ্য উৎপাদনের বড় যোগান হতে পারে দেশের উত্তরের চরাঞ্চলগুলো।
রংপুর বিভাগ মূলত চরের জন্য বেশ সুপরিচিত। বিভাগে ছোট-বড় মিলিয়ে এমন চরের সংখ্যা ছয় শতাধিকেরও বেশি। শুকনো মৌসুম ছাড়াও বছরের বিভিন্ন সময় এসব চরে নানা ধরনের ফসল ফলিয়ে থাকেন কৃষকরা। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে এসব ফসল চলে যাচ্ছে দেশের নানা প্রান্তে। চরাঞ্চলের কৃষকরা বন্যা-খরাসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে উৎপাদিত ফসল দিয়ে দেশের খাদ্য চাহিদার বড় একটি অংশের যোগান দিয়ে যাচ্ছেন।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ শাহ আলম বলেন, রংপুর অঞ্চলে প্রায় এক লাখ হেক্টর চরে আবাদ হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ফসল। এরই মধ্যে চর অঞ্চলের কৃষকদের সহযোগিতায় কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যাতে উৎপাদন বাড়বে দ্বিগুণ। প্রতি বছর উত্তরের চরগুলোতে প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকার ফসল উৎপাদন হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
এদিকে শুধু কৃষিতেই নয়, গবাদি পশুর চাহিদারও বড় একটি জোগান দিয়ে থাকেন চরের বাসিন্দারা। প্রাণিসম্পদ দপ্তরের তথ্য বলছে, প্রতি বছর উত্তরাঞ্চলের চরগুলোতে প্রায় ২৫ লাখ গবাদি পশু লালন-পালন হয়ে থাকে। যার বাজার মূল্য এক হাজার কোটি টাকারও বেশি। তবে আকস্মিক বন্যা আর নদী ভাঙনে এসব গবাদি পশু নিয়ে বিপদে পড়তে হয় চরবাসীদের।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ও উন্নয়ন গবেষক কুন্তলা চৌধুরী বলেন, চরাঞ্চলের বাসিন্দান্দের জন্য কৃষিতে বিশেষ ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব দিতে হবে। একই সঙ্গে তালিকা প্রণয়নের মাধ্যমে তাদেরকে জলবায়ু ঝুঁকি বীমার আওতায় আনতে হবে।
তিনি আরও বলেন, প্রতি বছর দেশে শূন্য দশমিক ৭০ শতাংশ কৃষি জমি কমছে। কিন্তু পরিমাণ বাড়ছে চরের। তাই চরের কৃষি ব্যবস্থাপনায় বিশেষ প্রকল্পের পাশাপাশি বন্যা, খরাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ সহনীয় নানা রকম ফসলের জাত উদ্ভাবনের ওপর নজর দেওয়া জরুরি।
সূত্র :ঢাকা পোষ্ট
Leave a Reply