1. admin@ritekrishi.com : ritekrishi :
  2. ritekrishi@gmail.com : ritekrishi01 :
তিস্তার চরের মিষ্টি কুমড়া যাচ্ছে মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুর
বুধবার, ২৬ মার্চ ২০২৫, ০২:০৪ অপরাহ্ন

তিস্তার চরের মিষ্টি কুমড়া যাচ্ছে মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুর

  • আপডেটের সময় : সোমবার, ৬ মার্চ, ২০২৩
  • ৩৪৮ পড়া হয়েছে

তিনি রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার গজঘণ্টা ইউনিয়নের তিস্তা নদী বেষ্টিত ছালাপাক চরের বাসিন্দা। প্রতি বছর বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে তিস্তা পাড়ের চান মিয়াদের লড়তে হয় নদী ভাঙনের সঙ্গে। কখনো নদীগর্ভে বিলীন হয় তাদের বসতভিটে, কখনো চাপা পড়ে তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন। তারপরও হাড়ভাঙা পরিশ্রমে থেমে থাকে না তাদের জীবনযুদ্ধ। এবার মিষ্টি কুমড়া ঘিরে দেখা স্বপ্ন পূরণে খুশি চান মিয়ারা।

প্রায় ছয় বছর পর আবারও তিস্তার দুর্গম চরাঞ্চলে চাষ করা হাইব্রিড জাতের মিষ্টি কুমড়া রপ্তানি হচ্ছে মালয়েশিয়া আর সিঙ্গাপুরে। এই দিনটা একটু আলাদা করেই ধরা দিয়েছে চান মিয়াদের কাছে। বিস্তীর্ণ চরে তাদের চাষ করা মিষ্টি কুমড়া দেশ ছাড়িয়ে বিদেশিদের পাতে পড়বে এই আনন্দে ভাসছেন চাষিরা।

জানা গেছে, গঙ্গাচড়া উপজেলার তিস্তা নদীর দুর্গম চরাঞ্চলে উৎপাদিত হাইব্রিড জাতের মিষ্টি কুমড়া রপ্তানি হচ্ছে মালয়েশিয়া আর সিঙ্গাপুরে। এর আগে ২০১৬ সালে বেসরকারি উন্নয়নমূলক সংস্থা প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশন বাংলাদেশের উদ্যোগে চরে চাষ করা মিষ্টি কুমড়া পৌঁছেছিল বিদেশের ভোক্তাদের পাতে। আর এবার কৃষি বিভাগের দিকনির্দেশনা ও এমফোরসি প্রকল্পের সহায়তায় রংপুর এগ্রোসহ দুটি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান কৃষকদের ক্ষেত থেকে সরাসরি মিষ্টি কুমড়া কিনে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে পাঠাচ্ছেন।

ইতোমধ্যে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ২০ কোটি টাকার মিষ্টি কুমড়ার অর্ডার পেয়েছেন। এ কারণে চাষিদের কাছ থেকে তারা সরাসরি মিষ্টি কুমড়া কিনে প্যাকেটজাত করছে। তবে শুধু বিদেশেই নয়, স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে চরে আবাদ করা মিষ্টি কুমড়া দেশের ১৭টি জেলাতেও পাঠানো হচ্ছে বলে চাষিরা জানিয়েছেন।

সম্প্রতি তিস্তা নদী বেষ্টিত গজঘণ্টা ইউনিয়নের ছালাপাক ও পূর্ব ইছলির চরাঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, ধু-ধু বালুচরে বিস্তীর্ণ সবুজের সমারোহ। কয়েক বছর ধরে চান মিয়ার মতো তিস্তার দুর্গম বালুচরে মিষ্টি কুমড়ার চাষাবাদ করে আসছেন লিটন, মকসুদ, এনামুল, মজিবর রহমানেরা। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে চরাঞ্চলের একসময়ের পতিত জমিগুলোতে সবুজের বিপ্লব ঘটাতে জুড়ি নেই তাদের।

ছালাপাক গ্রামে প্রায় ৫০০ কৃষক পরিবারের বসবাস। জনসংখ্যা প্রায় ২ হাজার ৩৮০ জন। যাদের ৮৫ ভাগ কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত। ভূমিহীন, গৃহহীন ও নিম্নআয়ের এসব পরিবার এখন চরজুড়ে মিষ্টি কুমড়া, আলু, ভুট্টা, বাদাম, পেঁয়াজ, ধান চাষাবাদ করছেন। পাশাপাশি তাদের রয়েছে গবাদি পশু ও ছাগল পালন। তবে গেল কয়েক বছর ধরে লাভ বেশি হওয়াতে মিষ্টি কুমড়ায় ঝুঁকেছেন চাষিরা।

তিস্তার পাড় ঘেঁষে হাঁটলে জানা যায় চরে মিষ্টি কুমড়া চাষে তৃণমূলদের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। চরের জমিতে সোলার পাম্প ব্যবহৃত স্যালো মেশিন দিয়ে মিষ্টি কুমড়ার ক্ষেতে পানি দিচ্ছিলেন কৃষক মজিবর রহমান। তার মতো আরও অনেকেই গর্তে ও গাছে পানি দেওয়া নিয়ে ব্যস্ত। ছালাপাকের চরে প্রায় দেড় হাজার হেক্টর জমিতে এবার উন্নত জাতের হাইব্রিড মিষ্টি কুমড়ার চাষ হয়েছে। তবে গত বছরের তুলনায় এবার ফলন আশানুরূপ হয়নি জানিয়েছেন মজিবর রহমান।

সত্তরোর্ধ্ব বয়সী এই কৃষক জানান, এবার ৮০ শতাংশ জমিতে তিনি মিষ্টি কুমড়ার চাষ করেছেন। বীজ, সার, জমি তৈরি ও সেচ দেওয়াসহ তার খরচ হয়েছে প্রায় ২০ হাজার টাকা। ইতোমধ্যে রপ্তানিকারকরা তার ক্ষেত থেকে ১৯ টাকা কেজি মূল্যে ২০ বস্তা মিষ্টি কুমড়া কিনে নিয়েছেন। ফলন কম হলেও চাহিদা বেশি হওয়ায় ভালো দাম পাচ্ছেন তিনি। এতে তার ৫০ হাজার টাকার বেশি লাভ হবে বলে মনে করছেন।

একই গ্রামের চাষি বুলবুলি বেগম এই প্রতিবেদককে বলেন, আগে তামাক চাষ করতাম। এখন চার বছর ধরে আমরা মিষ্টি কুমড়ার চাষ করছি। সংসারে অনেক আয় উন্নতি হয়েছে। এবারও কুমড়ার চাষ করেছি। এখন পর্যন্ত দুই লাখ টাকার মিষ্টি কুমড়া বিক্রি করছি। আরও তিন-চার লাখ টাকার মতো মিষ্টি কুমড়া বিক্রি করা সম্ভব হবে।

তিনি আরও জানান, উন্নত জাতের মিষ্টি কুমড়া আগের মতো ৮ থেকে ১০ কেজির হয় না। এটা সর্বোচ্চ ৪ থেকে ৫ কেজি ওজনের হয়। তবে চাহিদা বেশি ২-৩ কেজি ওজনের মিষ্টি কুমড়ার। প্রথম দিকে ২২ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছেন, এখন ১৬ থেকে ১৯ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন। রপ্তানি শুরু হওয়াতে আপাতত দাম কমার সম্ভাবনা নেই।

চরের বুকে হাঁটু পানিতে ভাসতে থাকা নৌকায় বসে কথা হলো কৃষক সামসুল হকের সঙ্গে। এই কৃষক জানান, একদিকে ভালো দাম পাবেন, অন্যদিকে নিজেদের কাছে গর্ব যে, তাদের চাষ করা মিষ্টি কুমড়া বিদেশিরা খাবেন। এটা তাদের কাছে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চরাঞ্চলের ভূমিহীন ও কৃষিনির্ভর পরিবারের স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে এসেছে বেসরকারি উন্নয়নমূলক সংস্থা এমজেএসকেএস, পাম্পকিং প্লাস, এমফোরসি ও বগুড়ার পল্লি উন্নয়ন একাডেমি। বিশেষ করে এমফোরসি তিস্তার চরে মিষ্টি কুমড়া চাষে উন্নত প্রযুক্তি ছড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি কৃষকদের প্রয়োজনীয় কারিগরী পরামর্শ ও উপকরণ সরবরাহ করে যাচ্ছে। একই সঙ্গে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে কৃষকদের ফসল সংগ্রহ, পরিচর্যা, ফসলের মান নির্ধারণ, সংরক্ষণ, বাজার সংযোগ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন তারা। এতে করে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম নিশ্চিত হবার পাশাপাশি রপ্তানিকারকদের সঙ্গে কৃষকদের যোগসূত্রও তৈরি হচ্ছে।

২০২০ সাল থেকে রংপুর জেলার চরের বাজার ব্যবস্থা উন্নয়নে কাজ করছে চর বাজার উন্নয়ন প্রকল্প ‘মেকিং মার্কেট ওয়ার্কস ফর দ্য চর-এমফোরসি’। প্রকল্পটির অর্থায়নে রয়েছে বাংলাদেশ সরকার ও সুইজারল্যান্ড সরকার। এমফোরসি প্রকল্পের উদ্যোগ ও সহায়তায় গত কয়েক বছর ধরে ভূমিহীনরা চর এলাকায় মিষ্টি কুমড়া চাষ করছেন। এতে একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষদের জীবনের মানও পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। কৃষকেরা সচেতন হয়ে উন্নত পদ্ধতি অনুসরণ করে ফসলের ভালো ফলন, গুণগুত মান ও ভালো দাম পেতে শুরু হওয়াতে দারিদ্র্যের শিকল ভেঙে স্বচ্ছলতায় ফিরছেন তারা। এ সফলতায় অল্প আয়ের মানুষদের জীবনের গতি অনেকটা পরিবর্তন হয়ে গেছে।

তিস্তার কোলঘেষা দুর্গম চর থেকে গ্রামীণ অবকাঠামোময় কিছু সড়ক পেরিয়ে যেতেই নজর কাড়বে উন্নত রাস্তাঘাট, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বাজার ব্যবস্থাপনা। ছালাপাক চরের কাছেই গজঘণ্টা মতলেব বাজার। সেখানে রয়েছে কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের জন্য শস্য সংরক্ষণ গুদাম ঘর। এর পাশে প্যাকেটজাত করা হচ্ছে বিদেশে রপ্তানিযোগ্য মিষ্টি কুমড়া।

ভালো করে পরিষ্কার করার পর মিষ্টি কুমড়া কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে প্লাস্টিকের বস্তায় ভরে সেলাই করা হচ্ছে। বিদেশে রপ্তানি হবে বলে ভালো মানের মিষ্টি কুমড়া বাছাই করছিলেন ফুলজান বেগম। তিনি প্রতিবেদককে জানান, অনেক সময়ে ভালো ফলন হলেও ন্যায্য দাম পাওয়া যায় না। এতে যা আয় হওয়ার কথা তা হয় না। বিদেশে রপ্তানির সুযোগ করে দেওয়ায় আর এ সমস্যা থাকবে না। অনেক বেশি দাম পাওয়া যাবে। এটা তাদের জন্য অনেক বড় পাওয়া। পাশাপাশি গ্রামের অসহায় দিনমজুরদের আয়ের সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে।

গজঘণ্টা ইউনিয়নের পূর্ব ইছলি গ্রামের বাসিন্দা দুলাল মিয়া। তিনি সেখানকার ইউপি সদস্য। তিনি জানান, গঙ্গাচড়া উপজেলার ৯০ ভাগ এলাকাই হচ্ছে তিস্তা নদী বেষ্টিত। এখানে দেড় শতাধিক ছোট-বড় চর রয়েছে। এর মধ্যে ২২টি চরে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিভিন্ন জাতের মিষ্টি কুমড়ার চাষাবাদ হচ্ছে। দুর্গম চরাঞ্চলের তপ্ত বালু চরে গর্ত করে সেখানে গোবর, সার আর মাটি দিয়ে মিষ্টি কুমড়া চাষ করা হয়। মূলত শুষ্ক মৌসুমে মিষ্টি কুমড়া চাষ করা হয়। এ সময় তিস্তা নদীতে পানি একেবারেই থাকে না। নদীর বেশিরভাগ স্থানে জেগে ওঠা চরে মিষ্টি কুমড়া চাষাবাদ করছে চাষিরা।

মিষ্টি কুমড়া রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান রংপুর এগ্রোর কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান রতন জানান, তারা চাষিদের কাছ থেকে ১৬-১৯ টাকা কেজি দরে সরাসরি ক্ষেত থেকে মিষ্টি কুমড়া কিনছেন। এরপর প্যাকেজজাত করে বস্তায় ভরে ট্রাকে করে ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছেন। মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে চরাঞ্চলের মিষ্টি কুমড়ার চাহিদা রয়েছে। ইতোমধ্যে তিন কোটি টাকার মিষ্টি কুমড়া বিদেশে পাঠানো হয়েছে। দুই দেশে প্রায় ২০ কোটি টাকার মিষ্টি কুমড়া রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে বলেও তিনি জানিয়েছেন।

এদিকে রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ ওবায়দুর রহমান মন্ডল বলেন, আপাতত দুই দেশে মিষ্টি কুমড়া রপ্তানি হলেও চরাঞ্চলের উৎপাদিত মিষ্টি কুমড়ার চাহিদা দেশের বিভিন্ন জেলায় রয়েছে। এতে করে চাষিরাও লাভবান হচ্ছে। এতে চরাঞ্চলে টেকসই ফসল উৎপাদনও সম্ভব হচ্ছে। তবে সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন মিষ্টি কুমড়া বিদেশে রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হবে।

তিনি আরও বলেন, তিস্তার চরে চাষ করা এসব মিষ্টি কুমড়া খেতে খুবই সুস্বাদু। এছাড়া কীটনাশক ও কোনো ধরনের ক্ষতিকারক ওষুধও ব্যবহার করা হয় না। অর্গানিক পদ্ধতিতে চাষ করা হয়। ফলে দেশ ও বিদেশের বাজারে এসব কুমড়ার চাহিদা অনেক বেশি। তাছাড়াও চরে উৎপাদিত এসব মিষ্টি কুমড়ার মান ভালো এবং সহজে পচে না। এ কারণে বাইরের দেশে প্রচুর চাহিদা রয়েছে।
সূত্র : ঢাকা পোষ্ট

সোস্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Error Problem Solved and footer edited { Trust Soft BD }
More News Of This Category
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত - রাইট কৃষি-২০২১-২০২৪
Web Design By Best Web BD