চৈত্রের তপ্ত দুপুর। চিকচিক করছে আত্রাই নদের চর। অপেক্ষাকৃত চরের উঁচু অংশে মাথা দুলিয়ে নাচছে গমের সোনালি রঙের শিষগুলো। গমখেতের পাশেই লাগানো হয়েছে মরিচ, পেঁয়াজ, মিষ্টিকুমড়া, ইসকোয়াশ। মাচাংয়ে ঝুলছে লাউ। মরিচখেতে নিড়ানি দিচ্ছেন ষাটোর্ধ্ব মোখলেছার-এলিজা দম্পতি। আত্রাইয়ের চরে কৃষিকাজ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন তাঁরা। আত্রাই যেন আশীর্বাদ হয়ে ধরা দিয়েছে তাঁদের কাছে।
খরস্রোতা আত্রাই নদে প্রায় ১০০ বিঘা আয়তনের এই চরের দেখা মিলবে দিনাজপুর সদর উপজেলার শংকরপুর ইউনিয়নের বনতাড়া এলাকায়। স্থানীয়ভাবে চরের নাম চক গোপাল। নদের পূর্ব পাশে ভারতের সমজিয়া হাট এলাকা। পশ্চিমে বাংলাদেশের বনতাড়া গ্রাম। চরের নামেই পাড়ার নামকরণ করা হয়েছে চক গোপাল। মোখলেছার-এলিজা দম্পতির মতো চার যুগের বেশি সময় ধরে গ্রামের অর্ধশত কৃষক চরের মাটিতে কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
মোখলেছার জানান, বাপ-দাদারা চরে আবাদ করেছেন। বালুতে তেমন আবাদ হতো না। চরটাও ছোট ছিল। ২০১৭ সালে বন্যার পর থেকে নদীতে তেমন পানি থাকে না। নদীতে বাঁধ দেওয়ার সময় কাজে অংশ নিয়ে গাড়িচাপা পড়ে তাঁর কোমরের হাড় ভেঙে যায়। তারপর থেকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে চরটা আমাদের আয়ের প্রধান উৎস। এবার আলু লাগিয়েছিলাম দেড় বিঘা। ৬০ হাজার টাকা খরচ করে। ১ লাখ ২২ হাজার টাকার আলু বিক্রি করেছি। আলু তুলে গম লাগিয়েছি ২ বিঘা। সর্বনিম্ন ৪০ মণ গম পাব। পাশাপাশি মরিচ-পেঁয়াজ তো আছেই।’
গত সোমবার দুপুরে চক গোপাল চর ঘুরে দেখা যায়, বিশাল এলাকাজুড়ে গমখেত। সোনালি রঙের গমের শিষগুলো মাথা দুলিয়ে নাচছে। গমখেতের কিছু অংশ এখনো সবুজ। কয়েকজন কৃষক শেষ সময়ে সেচ দেওয়ার কাজে ব্যস্ত। মরিচখেতে নিড়ানি দিচ্ছেন কয়েকজন নারী। তাঁদেরই একজন রাবেয়া খাতুন (৪০)। চরে আঠারো শতক (৪৫ শতক) জমিতে আবাদ করেন তিনি।
রাবেয়া খাতুন বলেন, ‘এই চরে কৃষিকাজের সাথে যারা যুক্ত, তাঁদের অধিকাংশই নারী। বাড়ির কাজকর্ম শেষ করে বাকি সময়টা চরেই কাটে আমাদের। এমন অনেকেই আছি তেল-লবণ ছাড়া কিছুই কিনি না। শাকসবজি থেকে শুরু করে গম, ভুট্টা সবকিছুই এখানে আবাদ করি।’
কৃষকেরা জানান, চরের প্রধান ফসল গম ও আলু। কাউকে জমির ভাড়া দিতে হয় না। কারও দখলে ১০ কাঠা, কারও দখলে দুই বিঘা। এভাবেই চাষাবাদ করে খাচ্ছেন। এবার চরে গম আবাদ হয়েছে প্রায় ২০ বিঘা। কৃষক বাবলু হোসেন (৪৫) জানান, বিঘাপ্রতি ১২-১৪ মণ গম পেতেন। গত দুই বছর থেকে স্থানীয় বেসরকারি একটি সংস্থার মাধ্যমে গম ও ভুট্টার উন্নত বীজ পেয়েছেন। গতবার বিঘাপ্রতি ১৯ মণের বেশি গম পেয়েছেন। এবারও ফলন ভালো হয়েছে। সপ্তাহখানেক পরেই কাটা শুরু করবেন।
কয়েক বছর ধরে এখানকার কৃষকদের আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তির আওতায় নিয়ে এসেছে স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা এমবিএসকে। প্রতিষ্ঠান কৃষকদের বিনা মূল্যে সার, বিভিন্ন ফসলের বীজ ও সেচকাজে সহযোগিতা করে আসছে। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা আবু সুফিয়ান বলেন, ‘সেখানে আমাদের কিছু উপকারভোগী সদস্য আছেন। চরে আবাদ করার বিষয়টি আমাদের নজরে এলে আমরা কৃষি উন্নয়নে এলাকার কৃষকদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি। বিভিন্ন সময়ে তাঁদের নিয়ে কৃষক সমাবেশও করা হয়।’
সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান বলেন, আত্রাই নদের তীর ঘেঁষে প্রায় ১০০ বিঘা আয়তনের চরের জমিতে স্থানীয়রা কৃষিকাজ করছেন। এবার গম আবাদ হয়েছে প্রায় ২০ বিঘায়। কৃষি বিভাগ প্রণোদনাসহ পরামর্শ দিয়ে আসছে। তিনি বলেন, দিনাজপুরের ওপর দিয়ে ছোট–বড় ১৯টি নদ-নদী প্রবাহিত হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে এসব নদীর জেগে ওঠা চরে বিভিন্ন কৃষিপণ্য আবাদ হচ্ছে। আবাদ ভালো হওয়ার কারণ চরে কিছু পলি জমা পড়ে জায়গাটি উর্বর হয়।
Leave a Reply