আমাদের গ্রামীণ প্রকৃতিতে আছে নানা ধরনের গাছপালা, উদ্ভিদ ও লতাপাতা। যা প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এদের মধ্যে অন্যতম স্বর্ণলতা। একসময় গ্রামের মেঠোপথ ধরে হেঁটে গেলে দেখা মিলতো গাছের ডালে জড়িয়ে থাকা এই পরজীবী লতাটি। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামীণ প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে ওষুধি গুণে ভরপুর উপকারী উদ্ভিদটি।
স্বর্ণলতা পরজীবী উদ্ভিদ। গাছেই এর জন্ম, গাছেই এর বেড়ে ওঠা ও বংশ বিস্তার। এর ইংরেজি নাম জায়ান্ট ডডার, বৈজ্ঞানিক নাম কাসকিউটা রিফ্লেক্সা। কাসকিউটা গণের এই উদ্ভিদের প্রজাতি রয়েছে ১৭০টির মতো। এটি একবর্ষজীবী এবং পত্রহীন উদ্ভিদ। ফুল আসে বসন্ত ঋতুতে। এ ফুল থেকে একধরনের ফল জন্মায় এবং সেই ফলে থাকা বীজ থেকেই স্বর্ণলতার বংশবৃদ্ধি ঘটে। বাংলাদেশে স্বর্ণলতার কয়েকটি প্রজাতি দেখা যায়।
স্বর্ণলতা জীবন্ত গাছে জন্ম নিয়ে ওই গাছকে অবলম্বন করেই বেঁচে থাকে। যে গাছে এটি জন্মায়, তার ডাল ও কাণ্ড থেকে সরাসরি খাদ্য সংগ্রহ করে। এই লতার হস্টেরিয়া নামের চোষক অঙ্গ থাকে, যার মাধ্যমে এটি আশ্রয়ী গাছ থেকে পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করে। দ্রুত বর্ধনশীল এই লতা অল্প সময়েই বহু শাখা-প্রশাখা গজিয়ে তোলে এবং আশ্রয়ী গাছটিকে পুরোপুরি আচ্ছাদিত করে ফেলে।
প্রকৃতিতে সৌন্দর্য বাড়িয়ে তোলার ক্ষেত্রে যেসব লতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, তাদের মধ্যে অন্যতম হলো স্বর্ণলতা। শ্যামল বাংলার পথে-প্রান্তরে এই উদ্ভিদ নিজস্ব ভঙ্গিতে ছড়িয়ে দেয় রূপের মহিমা। দেশের প্রায় সব এলাকায় স্বর্ণলতা দেখা যায়। গ্রামে বসবাসকারী বা গ্রামে যাতায়াত রয়েছে এমন সব বয়সী মানুষই কম-বেশি এ উদ্ভিদকে চিনে থাকেন।
বাংলাদেশের আবহাওয়া স্বর্ণলতার জন্য অত্যন্ত অনুকূল। তাই গ্রামীণ ও পাহাড়ি অঞ্চলে উপযুক্ত আশ্রয়ী গাছে সহজেই জন্ম নেয় এ পরজীবী লতা। তবে সাধারণত বরই গাছের কাণ্ডে বেশি দেখা যায়। দেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলেই কম-বেশি এ উদ্ভিদ দেখা যায়। বিশেষ করে রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চল ও ঢাকা বিভাগের গাজীপুর, ভাওয়াল গাজীপুর, সাতখামাইর ও শ্রীপুর এলাকায় সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।
লতাটি সবুজাভ উজ্জ্বল রং দূর থেকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। দূর থেকে তাকালে মনে হয়—গাছের ডাল থেকে ঝুলে আছে ঝুরি ঝুরি হলদে সুতা। তার ওপর রোদের আলো পড়লে চকচক করে ওঠে—দেখতে হয়ে ওঠে অসাধারণ রকমের সুন্দর। স্বর্ণলতার বেড়ে ওঠা এবং ফুল ফোটার মূল মৌসুম হলো পৌষ থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত। মৌসুম ছাড়াও এটি প্রকৃতিতে টিকে থাকে ও সৌন্দর্য ছড়ায়।
আয়ুর্বেদ শাস্ত্র অনুযায়ী, স্বর্ণলতায় রয়েছে বিস্ময়কর ওষুধি গুণ। আদিকাল থেকেই এটি ভেষজ ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। স্বর্ণলতাকে কফনাশক, কৃমিনাশক, খোসপাঁচড়া নিবারণকারী, রক্তদুষ্টিনাশক, পিত্তনাশক ও বায়ুনাশক হিসেবে গণ্য করা হয়। এ ছাড়াও চুলকানি, উচ্চরক্তচাপ, হাড়ের সমস্যা, ডায়াবেটিস, জন্ডিস, যকৃতের রোগ ও শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন জটিল রোগের নিয়ন্ত্রণ ও নিরাময়ে এর ব্যবহার উল্লেখযোগ্য।
শরীরের ক্ষত সারাতে স্বর্ণলতা পিষে ক্ষতস্থানে প্রলেপ দিলে তা দ্রুত সেরে যায়। পেট ব্যথা উপশমে এটি খুবই কার্যকর। মুখের ঘা সারাতে এ লতা সেদ্ধ করা পানি দিয়ে কুলকুচি করলে অল্প সময়েই উপকার পাওয়া যায়। স্বর্ণলতার নির্যাস পেট ফাঁপা এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতেও অত্যন্ত উপকারী। এককথায়, এটি বহু গুণসম্পন্ন ভেষজ লতা, যার ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকেই স্বাস্থ্যচর্চায় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয়ে আসছে।
একসময় দেশের পথে-প্রান্তরে, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকাগুলোতে স্বর্ণলতা সহজেই চোখে পড়তো। বরই গাছ মূলত এ লতার প্রধান আশ্রয়দাতা গাছ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু বর্তমানে পাড়াগাঁয়ে পথের ধারে বরই গাছ আগের মতো অবহেলায় কিংবা প্রাকৃতিকভাবে সহজে বেড়ে ওঠে না। যেসব গাছ এখনো টিকে আছে, সেগুলোর মালিকেরা পরিকল্পিত চাষ ও বেশি ফলনের আশায় প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময়ে গাছের ডালপালা ছেঁটে ফেলেন। ফলে আশ্রয় হারায় উপকারী এ উদ্ভিদ। যদিও সেই গাছে পরবর্তীতে নতুন ডালপালা গজায়, তবে স্বর্ণলতা আর ফিরে আসে না। কোথাও বা অল্প কিছু জন্মালেও তাকে আগাছা মনে করে উপড়ে ফেলা হয়। এভাবেই ধীরে ধীরে আমাদের প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ওষুধি গুণে সমৃদ্ধ স্বর্ণলতা।
Leave a Reply