বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার নশরতপুর ইউনিয়নের চাটখইর গ্রামের রাফছান জানী (৩২) একসময় ছিলেন ক্রিকেটার। প্রিমিয়ার লিগে ধানমন্ডি ক্লাবের হয়ে খেলেছেন। কিন্তু পারিবারিক দায়িত্বের কারণে তাঁকে ক্রিকেট ছাড়তে হয়। পরে চাকরি করলেও স্বল্প বেতনের কারণে সে পথেও বেশি দূর এগোনো হয়নি। শেষ পর্যন্ত কৃষিকাজেই খুঁজে পান নতুন পথ। পতিত জমিতে ব্যাগিং পদ্ধতিতে আদা চাষ করে এখন তিনি এলাকায় সফল চাষি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন।
বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার নশরতপুর ইউনিয়নের চাটখইর গ্রামে রাফছান জানীর বাড়ি; বাবার নাম সাইফুল ইসলাম। শৈশব থেকেই রাফছান জানীর পড়ালেখার পাশাপাশি ঝোঁক ছিল ক্রিকেটে। ভর্তি হন বগুড়ার ইয়ং টাইগার্স ক্রিকেট একাডেমিতে। সেখান থেকেই শুরু একাডেমিক ক্রিকেটে তাঁর যাত্রা। পরে প্রিমিয়ার লিগে ধানমন্ডি ক্লাবের হয়ে খেলেন।
অনুশীলনের সময় ইনজুরির কারণে একসময় ক্রিকেট ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন রাফছান জানী। রাজশাহী নিউ গভর্নমেন্ট ডিগ্রি কলেজ থেকে স্নাতক (পাস) এবং নওগাঁ সরকারি কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার পর জীবিকার প্রয়োজনে ২০২১ সালে প্রাণ গ্রুপে বিক্রয়কর্মী হিসেবে চাকরি নেন। পাশাপাশি সরকারি চাকরির জন্যও চেষ্টা করেন। এক বছরের মাথায় চাকরি ছেড়ে ফিরে আসেন গ্রামে। বাবার সঙ্গে কৃষিকাজে যুক্ত হন।
শখের চাষে অপ্রত্যাশিত সাফল্য
ইউটিউবে ব্যাগিং পদ্ধতিতে আদা চাষের ভিডিও দেখে অনুপ্রাণিত হন রাফছান। বছরখানেক আগে বাড়ির পাশে পতিত জমিতে এক হাজার জিও টেক্সট ব্যাগে আদা চাষ শুরু করেন। এতে খরচ হয় ১৮ হাজার টাকা। প্রথম বছরেই ৪৭ হাজার টাকার আদা বিক্রি করে লাভ পান দ্বিগুণের বেশি।
এই সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে এ বছর বাড়ির পাশে দুই একর পতিত জমিতে ১০ হাজার জিও ব্যাগে উচ্চ ফলনশীল আদা চাষ করেছেন তিনি। খেত থেকে আদা তোলা শুরু করেছেন। প্রতি ব্যাগে গড়ে ৮০০ গ্রাম থেকে এক কেজি পর্যন্ত ফলন পাচ্ছেন। ইতিমধ্যে ২০০ কেজি আদা ১২০ টাকা দরে বিক্রি করেছেন।
রাফছান জানী বলেন, ‘আদার চাষপদ্ধতি কিছুই জানতাম না। ইউটিউবে ভিডিও দেখেই ‘ব্যাগিং পদ্ধতি’ অর্থাৎ বস্তায় মাটি ভরাট করে আদা চাষে ঝুঁকেছিলাম। গত বছর এক হাজার বস্তায় চাষ করে ১৮ হাজার টাকার খরচে ৪৬ হাজার টাকার আদা বিক্রি করেছিলাম। এ বছর ১০ হাজার জিও ব্যাগে চাষ করেছি। সব মিলিয়ে এবার আদা বিক্রি করে সাত লাখ টাকা হাতে আসবে বলে আশা করছি।’
সীমিত খরচে লাভজনক পদ্ধতি
রাফছান জানী বলেন, ব্যাগিং পদ্ধতিতে সীমিত খরচে কম জায়গায় বেশি চারা রোপণ করা যায়। অল্প শ্রমে বেশি লাভ হয়। সেচ, সার ও কীটনাশকের ব্যবহারও সীমিত। তেমন পরিচর্যা লাগে না বললেই চলে।
তাঁর সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে এলাকাতেও শুরু হয়েছে ব্যাগিং পদ্ধতিতে আদা চাষ। চাটখইর গ্রামের তরুণ উদ্যোক্তা ফারুক হোসেন ৩০০ জিও ব্যাগে, আর সাহারপুকুর বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সাইদুল ইসলাম খান ৫০০ জিও ব্যাগে আদা চাষ করেছেন।
গত বুধবার চাটখইর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির পাশে ঈদগাহসংলগ্ন পরিত্যক্ত মাঠে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন রাফছান জানী। তিনি এ মৌসুমে দুই একর জমিতে ব্যাগিং পদ্ধতিতে আদা চাষ করেছেন। খেতের আদা দেখতে উৎসাহী হয়ে আশপাশের কৃষকেরাও আসছেন।
আদমদীঘি উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘বস্তায় আদা চাষের জন্য আলাদা জমির প্রয়োজন হয় না। ব্যাগিং পদ্ধতিতে পরিত্যক্ত ও ছায়াযুক্ত জমিতেও চাষ করা যায়। এ পদ্ধতিতে মাটিবাহিত রোগের আক্রমণ কম হয়। অতিবৃষ্টি বা ঝড়ে সহজে বস্তা সরিয়ে নেওয়া যায়। কম খরচে বেশি লাভ হওয়ায় কৃষকেরা এই পদ্ধতির দিকে ঝুঁকছেন।’
বস্তায় আদা চাষের ধাপ
বস্তায় আদা চাষের পদ্ধতি সম্পর্কে রাফছান জানী বলেন, প্রথমে জমিতে হাল চাষ দিয়ে মাটি ঝরঝরে করে নিতে হয়। এরপর মাটির সঙ্গে ২০ শতাংশ জৈব বা গোবর সার, ২০ শতাংশ অটো মিলের ছাই, প্রয়োজনীয় বালু মাটি, দানাদার কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ভালোভাবে মিশিয়ে বস্তায় ভরতে হয়। প্রতিটি বস্তার ওজন হতে হবে গড়ে ২০ কেজি। উচ্চতা হতে হবে কমপক্ষে এক ফুট। এরপর বস্তা জমিতে সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে রাখতে হবে। দিনের বেশির ভাগ সময় রোদ পায়, এমন স্থানে বস্তাগুলো রাখতে হবে। ১০-১৫ দিন পর আদার ২-৩টি করে কন্দাল বপন করতে হবে। এরপর সেচ দিতে হবে। ২০-২৫ দিন পর আদা থেকে গাছ বের হবে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আদাগাছ বড় হতে থাকবে। চারা লাগানোর দুই মাস পর ১০ গ্রাম করে টিএসপি সার মাটিতে প্রয়োগ করতে হবে। বস্তার মাটি মাঝেমধ্যে খুঁড়ে একটু আলাদা করে দিতে হবে। এপ্রিল-মে মাসে আদা লাগালে ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে খেত থেকে পরিপক্ব আদা তোলা যায়। সময়ের আগে খেত থেকে আদা তুললে ফলন কম হবে।
চাহিদার তুলনায় ঘাটতি পূরণে ভূমিকা
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্যমতে, দেশে বছরে আদার চাহিদা ৪ লাখ ৮১ হাজার টন। উৎপাদন হয় ২ লাখ ২৪ হাজার টন। বাকিটা আমদানি করতে হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৯১ হাজার টন আদা আমদানি করা হয়।
উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা ফরহাদ হোসেন বলেন, আদমদীঘিতে এ মৌসুমে পাঁচ হেক্টর জমিতে আদা চাষ হয়েছে। এর বেশির ভাগই ব্যাগিং পদ্ধতিতে। উপজেলা কৃষি বিভাগ প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করছে। রাফছানের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে আরও অনেক কৃষক এই পদ্ধতিতে এগিয়ে আসছেন।
Leave a Reply