তুলা গাছ বাংলাদেশের চাষকৃত অর্থকরী ফসলের মধ্যে অন্যতম। গ্রামাঞ্চলে তুলা বলতে আমরা প্রথমত শিমুল তুলাকে বুঝি। তবে এর বাইরেও তুলার নানা জাতের গাছ আছে। যেমন- কারপাস গাছ, ফুটি কারপাস, সিল্ক তুলা প্রভৃতি। যা চাষ করতে হয়। বাংলাদেশেও তুলা চাষ করা যায়। আসুন জেনে নিই উপায় সম্পর্কে।
তুলা সাধারণত গরম ও শুষ্ক মৌসুমে ভালো জন্মে। বাংলাদেশে আগে মূলত দেশি প্রজাতির তুলা চাষ হতো। তবে বর্তমানে উচ্চফলনশীল হাইব্রিড এবং বিটি তুলার চাষও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তুলা গাছ সাধারণত একবর্ষজীবী উদ্ভিদ, যার গড় উচ্চতা ১ থেকে ২ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে।
গাছের কাণ্ড শক্ত। পাতা তালপাতার মতো ছড়ানো। ফুলগুলো সাধারণত হালকা হলুদ থেকে গোলাপি বর্ণের হয়। ফুল ঝরে যাওয়ার পরেই শুরু হয় তুলার বল তৈরি হওয়া। যা পরিপক্ব হলে ফুটে সাদা তুলার আঁশ বেরিয়ে আসে। বিশ্বব্যাপী ৫০টির বেশি প্রজাতি থাকলেও বাণিজ্যিকভাবে মাত্র ৪টি প্রজাতির তুলা উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হয়।
প্রতিটি প্রজাতির গঠনগত কিছু পার্থক্য থাকলেও তুলা গাছের মূল গঠন প্রায় একই। পাতাগুলো খাঁজযুক্ত, সবুজ রঙের ও কিছুটা রুক্ষ। ফুল গন্ধহীন এবং ফুল ফোটার পর ধীরে ধীরে তুলার বলে পরিণত হয়। এ পরিপক্ব তুলার বল ফেটে গিয়ে সাদা তুলার আঁশ বেরিয়ে আসে।
তুলা গাছ সাধারণত দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটিতে ভালো জন্মে। তবে পর্যাপ্ত জৈবপদার্থ সমৃদ্ধ যে কোনো মাটিতেই তুলার চাষ করা যায়। খুব বেশি বেলে বা কর্দমকণা সমৃদ্ধ মাটি তুলা চাষের জন্য উপযুক্ত নয়। যেসব জমিতে বৃষ্টির পানি থাকে না বা স্বাভাবিক বন্যায় পানি ওঠে না, এমন জমি তুলা চাষের জন্য নির্বাচন করা ভালো। যে জমি স্যাঁতসেঁতে, ছায়াযুক্ত এবং বৃষ্টির পানি ২-৬ ঘণ্টার মধ্যে নামে না; সেখানে তুলা চাষের জন্য নির্বাচন করা উচিত নয়। মাটির পিএইচ মান ৬.০-৭.৫ হওয়া উত্তম। মাটি বেশি অম্লীয় হলে জমিতে চুন প্রয়োগ করতে হবে।
চাষ দেওয়ার আগেই বিঘাপ্রতি ১.০-১.৫ টন গোবর বা কম্পোস্ট সার জমিতে ছিটিয়ে দিতে হবে। তারপর বৃষ্টির ফাকে ফাকে মাটির জো অবস্থা বুঝে ৩-৪টি চাষ ও মই দিয়ে জমি সমতল ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। বিভিন্ন আবর্জনা ও আগাছা উত্তমরূপে পরিষ্কার করতে হয়। প্রতিকূল পরিবেশে বিনা চাষে ডিবলিং পদ্ধতিতে তুলা বীজ বপন করে ফলন পাওয়া যায়।
ওপরে ছাউনির ব্যবস্থা করে কাগজ অথবা পলিথিন প্যাকেটে চারা তৈরি করে ১০-১২ দিন বয়সের চারা মূল জমিতে বপন করা যায়। এভাবে নাবীতে পাট ও আউশ ধান কেটে ওই জমিতে তুলা বপন করে ফলন পাওয়া যায়। জাতভেদে তুলার বীজ ১ আষাঢ় থেকে ১৫ শ্রাবণ পর্যন্ত বপনের সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। তবে ৩০ শ্রাবণ পর্যন্ত বীজ বপন করা যেতে পারে।
হাইব্রিড জাত আগাম বপন করা উত্তম। উপযুক্ত সময়ে বীজ বপন করা হলে তুলা উঠিয়ে ওই জমিতে সহজেই বোরো ধান, আলু, গম, ভুট্টা ও সবজির মতো উচ্চমূল্যের ফসল আবাদ করা যায়। তুলা উন্নয়ন বোর্ডের নিজস্ব উফশী ওপি জাতের ক্ষেত্রে বিঘাপ্রতি ১.০ কেজি এবং হাইব্রিডের ক্ষেত্রে ৫০০-৬০০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়। বীজ বপনের আগে তুলা বীজ ৩-৪ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে শুকনো মাটি বা ছাই দিয়ে ঘঁষে নেওয়া উত্তম। মনে রাখা দরকার, উচ্চ ফলনের জন্য বিঘাপ্রতি কমপক্ষে ৩ হাজার গাছ থাকা আবশ্যক।
বপনের আগে তুলা বীজ একটি পাত্রে নিয়ে তাতে প্রতি কেজি বীজের জন্য ৫ গ্রাম গাউচু বা কনফিডর বা একতারা কীটনাশক সামান্য পানি দিয়ে বীজের গায়ে মিশিয়ে নিতে হবে। যাতে কোনো অতিরিক্ত পানি না থাকে। এরপর ছায়ায় ৪০-৫০ মিনিট শুকিয়ে নিয়ে বপন করতে হবে।
তুলা বীজ সারিতে বপন করতে হয়। সারি উত্তর-দক্ষিণ বরাবর লম্বা-লম্বি করে তৈরি করতে হয়। উপযুক্ত সময়ে বীজ বপন করা হলে সব জাতের ক্ষেত্রেই সারি থেকে সারি ৯০ সেন্টিমিটার (৩ ফুট বা ২ হাত) এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৪৫ সেন্টিমিটার (১.৫ ফুট বা ১ হাত) বজায় রেখে বীজ বপন করতে হয়। সারি বরাবর মাটি উঁচু করে তার ওপর বীজ বপন করা উত্তম। কারণ এতে জমি থেকে পানি নিষ্কাশন সহজ হয়, চারা গাছ জলাবদ্ধতার হাত থেকে রক্ষা পায়। ফলে চারা গাছের বৃদ্ধি ভালো হয়। সারির ওপর নির্দিষ্ট দূরত্বে আধা ইঞ্চি গভীরে ২-৩টি বীজ সামান্য মাটি দিয়ে হালকাভাবে ঢেকে দিতে হবে। বীজ মাটির দ্বারা শক্ত করে ঢেকে দিলে অথবা গর্ত করে বেশি গভীরে বীজ দিলে চারা গজাতে অসুবিধা হতে পারে।
ভালো ফলন পেতে হলে তুলা ক্ষেতে উপযুক্ত সার সঠিক পরিমাণ ও নিয়মমাফিক ব্যবহার করতে হয়। মাটিতে জৈব ও রাসায়নিক উভয় প্রকার সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন। জৈব সার ব্যবহারে মাটির জৈব পদার্থ বৃদ্ধি পায়। ফলে মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ে। অণুজীবের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। অনুখাদ্যের পরিমাণ বাড়ে।
তুলা শুধু বস্ত্রশিল্পর জন্য উপকারী নয় বরং এর আছে ভেষজগুণও। এ ছাড়া বহু মানুষের জীবিকা তুলা চাষের ওপর নির্ভরশীল। তাই বাংলাদেশে তুলা উন্নয়ন বোর্ডের উচিত তুলা উৎপাদন বাড়াতে আরও কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া।
Leave a Reply