বাঁশের সবজি না হলে যেন খাবারে রুচিই আসে না পাহাড়িদের। স্থানীয় ভাষায় এ সবজির নাম বলে বাঁশকোড়ল। এটি পাহাড়িদের পাশাপাশি বাঙালিদের কাছেও সুস্বাদু পুষ্টিকর ও রুচিশীল সবজি হিসেবে পরিচিত। বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ের বাজারগুলোয় বিভিন্ন সবজির মধ্যে প্রধান সবজি হিসেবে বিক্রি হয় বাঁশকোড়ল।
মূলত বাঁশগাছের গোড়ার কচি অংশইকেই বাঁশকোড়ল হিসেবে বলা হয়। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর দৈনিক সবজির তালিকায় পছন্দের সবজি হিসেবে খাওয়া হয় এই বাঁশকোড়ল।
পাহাড়ের জুমচাষি ও বাঁশকোড়ল বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই সবজিকে বাঁশকোড়ল হিসেবে চিনলেও পার্বত্য জেলায় বসবাসরত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে এর রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন নাম। মারমা সাম্প্রদায়ের লোকেরা এটিকে বলে মহ্ই, আবার চাকমা সাম্প্রদায়ের লোকেরা বলে বাচ্ছুরি, ত্রিপুরারা মেওয়া নামে বলে থাকে।
বিশেষ করে বাঁশকোড়ল বর্ষাকালে বেশি পরিমাণে উৎপাদিত হওয়ায় এটিকে বর্ষাকালীন সবজি হিসেবেই ধরে নেওয়া হয়। বর্ষাকালে এ সবজি বাজারে বেশি পরিমাণে দেখা যায়। এটি বর্ষার শুরুতে বৃষ্টির পানিতে মাটি নরম হলে বাড়তে শুরু করে। মাটি থেকে ৪-৫ ইঞ্চি গজিয়ে উঠলে খাওয়ার উপযোগী হয়। জাতভিন্নতার সঙ্গে সঙ্গে বাঁশকোড়লের স্বাদেও ভিন্নতা আসে।
সরেজমিনে স্থানীয় বাজারগুলোয় দেখা গেছে, পাহাড়ি জনগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের অন্যতম সুস্বাদু খাবার বাঁশকোড়ল। পাহাড়ের গহিনে প্রায় সব স্থানেই দেখা মেলে এর। বর্ষা মৌসুমে জেলার পাহাড়ি এলাকার গহিনে প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেয় বাঁশ। আবার ব্যক্তিগত বাগানে লাগানো বাঁশ জন্ম নেয়। পাহাড়িরা বাঁশগাছের গোড়ার কচি অংশকে সংগ্রহ করে তা বাঁশকোড়ল নামে প্রতিদিন স্থানীয় বাজারে বিক্রি করতে নিয়ে আসে।
বছরের মে থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত এই সবজির ভরা মৌসুম থাকে। মুলি বাঁশ, ডলু বাঁশ, মিতিঙ্গ্যা বাঁশ, ফারুয়া বাঁশ, বাজ্জে বাঁশ, কালিছুরি বাঁশসহ বেশ কয়েক প্রজাতির বাঁশকোড়ল পাওয়া যায় স্থানীয় বাজারগুলোয়। পাহাড়ের গহিন অরণ্যের বিভিন্ন এলাকা থেকে দরিদ্র জুমচাষিরা এই বাঁশকোড়ল সংগ্রহ করে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে জীবিকা আয় করে থাকেন। তবে বাজারে এসব সবজি কেজিতে বিক্রি করা হয় না। আলাদা ৮ থেকে ১০টি বাঁশকোড়লের আটি বেঁধে ভাগ বসিয়ে বিক্রি করা হয়। প্রতি আঁটির দাম ধরা হয় ৮০ থেকে ১০০ টাকার মধ্যে। তবে অনেক সময় ৪০ থেকে ৬০ টাকা দরেও বিক্রি হয়।
স্থানীয় পাহাড়ি ব্যবসায়ীরা জানান, বান্দরবানে ঘুরতে আসা অনেক পর্যটকের কাছে এখনো আকর্ষণীয় এই পাহাড়ি সবজি বাঁশকোড়ল। এটি প্রথমে সেদ্ধ করে ভাজি, ভুনা এবং ডাল ও মুরগির মাংসের সঙ্গে মিশিয়ে নানাভাবে সুস্বাদু করে তরকারি রান্না করে খাওয়া যায়। বান্দরবান মগবাজারের, কালাঘাটা বড়ুয়ার টেক বাজার ও প্রতিদিন সন্ধ্যায় বালাঘাটা বাজারের পাশে বসে পাহাড়ি নারী ও পুরুষ এই সবজি বিক্রি করেন। বাজারের দুপাশে সারি সারি সাজানো থাকে নানা প্রজাতির পাহাড়ি বাঁশকোড়ল।
বালাঘাটা বাজারে বাঁশকোড়ল সবজি বিক্রি করতে আসা পাহাড়ি নারী মেনু চিং মারমা বলেন, আমি খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে বাঁশকোড়ল আহরণ করি। পরে বিকেলে বালাঘাটা বাজারে বিক্রি করতে আসি। কখনো বিক্রি হয়, কখনো হয় না। পাহাড় থেকে কুড়ানো সবজিগুলো বিক্রি করে আমাদের পরিবার চলেছে বলে তিনি জানান।
বান্দরবান সদর উপজেলার কুহালং ইউনিয়নের চেমী ডলুপাড়ার বাঁশকোড়ল বিক্রেতা গরামং মারমা বলেন, প্রতিবছর মে থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত আমরা বাস করার আহরণ করতে পারি। পাশাপাশি আমি বিভিন্নজন থেকে এসব সবজি কিনে বান্দরবান জেলার বাইরে ও বিক্রি করি। এ সবজি বিক্রি করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন অনেক পাহাড়ি ও তাদের পরিবার।
বান্দরবান মারমা বাজারের বাঁশকোড়ল বিক্রেতা সিংদাইমে মারমা জানান, বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশ থাকলেও সব বাঁশ থেকে কোড়াল সংগ্রহ করা যায় না। সব বাঁশকোড়ল খাওয়াও যায় না। যেগুলো খাওয়া যায়, তার মধ্যে মুলি বাঁশ, ফারুয়া বাঁশ, বাজ্জে বাঁশ, ডলু বাঁশ, মিতিংগ্যা বাঁশ এবং কালিছুরি বাঁশকোড়ল চিংড়ি মাছের নাপ্পি দিয়ে রান্না করে খেতে বেশ সুস্বাদু বলে তিনি জানান।
Leave a Reply