পশ্চিমবঙ্গ তথা দেশের বিস্তীর্ণ এলাকার জনপ্রিয় শীতকালীন ফসল হল সরষে। রাজ্যের প্রায় সমস্ত জেলাতেই শীতের শুরুতে মাঠ ঢেকে যায় হলুদ সরষে ফুলে। অপেক্ষাকৃত কম পরিশ্রম ও খরচে দ্রুত পাওয়া যায় ফসল। তাই রাজ্যে প্রতি বছরই বাড়ছে সরষে চাষ। তবে নিয়ম মেনে চাষ করলে পাওয়া যেতে পারে কিছু বাড়তি ফলন। সঙ্গে রোগপোকা আক্রমণের উপসর্গ ও প্রতিকার জানা থাকলে আরও সহজে সাফল্য মিলবে সরষে চাষে। এই চাষের ব্যাপারে বিস্তারিত জানিয়েছেন রাজ্যের কৃষি দফতরের উপদেষ্টা প্রদীপকুমার মজুমদার।
পশ্চিমবঙ্গে কী কী জাতের সরষে পাওয়া যায়?
প্রদীপ বাবু জানান, আমাদের রাজ্যে মূলত তিন প্রকারের সরষে চাষ করা হয়। এগুলি হল- ১) টোরি সরিষা, ২) শ্বেত সরিষা এবং ৩) রাই সরিষা।
১) টোরি সরিষা: আমাদের রাজ্যে বিভিন্ন ধরনের টোরি পাওয়া যায়। তবে এর মধ্যে উন্নত প্রজাতি হলো ‘অগ্রণী এবং পঞ্চালী।
২) শ্বেত সরিষা: বিনয়, সুবিনয় এবং ঝুমকা হলো উন্নত জাতের শ্বেত সরিষা।
৩) রাই সরিষা : উচ্চ ফলনশীল রাই সরিষার মধ্যে ভাগীরথী, সীতা, সরমা, সংযুক্তা হলো উল্লেখযোগ্য।
সরষে চাষের উন্নত পদ্ধতি
বিভিন্ন জাতের সরষের চাষ পদ্ধতি অনেকটা একই রকম। সরষের চাষ করার জন্য জল নিকাশির সুবিধাযুক্ত জমি প্রয়োজন। এছাড়াও মাটি হতে হবে বেলে দো-আঁশ বা দো-আঁশ।
প্রথমত, আশ্বিনের শেষ থেকে কার্তিকের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত সরষে রোপন করা যায়। তার আগে বেশ কয়েকবার জমির উপর লাঙল ও মই চালিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। সেক্ষেত্রে মাটিতে যদি রস কম থাকে তাহলে, জল সেচ করে চাষের জন্য উপযুক্ত জমি তৈরি করতে হবে। এরপর বীজ শোধন করতে হবে কৃষকদের।
জমিতে সেচের সুবিধা থাকলে, হালকা সেচ দিতে হবে। ভারী মাটি হলে, সেচের আগে চাপান সার দিতে হবে। অপরদিকে হালকা মাটির ক্ষেত্রে সেচের পর জল থিতিয়ে গেলে এই সার ছড়িয়ে দিতে হবে। শেষ চাষের আগে একর প্রতি ২ টন জৈবসার ভালোভাবে মাটিতে মিশিয়ে নিতে হবে। এছাড়া বীজ বপন করার ৩০ থেকে ৪৬ দিন পর নাইট্রোজেন, ফসফেট, পটাশ নির্দিষ্ট অনুপাতে প্রয়োগ করতে হবে।
সরষে চাষে রোগপোকার আক্রমণ
তবে সরষে চাষের ক্ষেত্রে খরচ সেরকম না থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই গাছে পোকার আক্রমণ বা বিভিন্ন ধরনের রোগ হলে সে ক্ষেত্রে উৎপাদন কমে যায়। ফলে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন কৃষকরা। রোগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সাদা মরিচা রোগ, শিকড় ফোলা রোগ, সরিষার ফলে ধ্বসা রোগ, গাছের ধ্বসা রোগ প্রভৃতি ধরনের সমস্যা বা রোগ সরষে গাছে দেখা যায়। এরমধ্যে প্রধান রোগ হলো ধ্বসা রোগ। যার ফলে সরষের ফলন ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। রোগের পাশাপাশি পোকামাকড়ের আক্রমণের ফলেও সরষের ফলন অনেক কমে যায়। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জাব পোকা, করাত মাছির লার্ভা, হীরক পিঠ মথ প্রভৃতি ধরনের পোকামাকড়ের আক্রমণের ফলে সরষের ফলন ৬০ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে।
কী কী উপায়ে প্রতিকার করবেন?
মূলত বিভিন্ন ধরনের রোগ এবং পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে সরষে গাছকে রক্ষা করার জন্য গাছে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ বা কীটনাশক স্প্রে করা হয়ে থাকে।
কৃষি দফতরের আধিকারিকরা জানাচ্ছেন, ধ্বসা রোগের ক্ষেত্রে আইপ্রোডায়ন প্রতি লিটার জলে ১ গ্রাম বা মেটালাক্সিল ও ম্যানকোজেব এর মিশ্রণ লিটার প্রতি জলে ২.৫ গ্রাম মিশিয়ে গাছে স্প্রে করতে হবে। এছাড়া শিকড় ফোলা রোগের ক্ষেত্রে বীজ বোনার ১ মাস আগে জমিতে চুন ছিটাতে হবে। পোকামাকড়ের আক্রমণের ক্ষেত্রে ক্ষেত্রে ডাইমিথয়েট বা থায়ামেথক্সাম কীটনাশক স্প্রে করতে হবে। সে ক্ষেত্রে ডাইমিথয়েট প্রতি লিটার জলে ২ মিলি মেশাতে হবে এবং থায়ামেথক্সামের ক্ষেত্রে ১/৩ গ্রাম হারে মেশাতে হবে। ভালো করে এই মিশ্রণ তৈরি করার পর সরষে গাছের ওপর স্প্রে করতে হবে। তবে কীটনাশক স্প্রে করার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে অর্থাৎ যেকোনও সময় স্প্রে করলে চলবেনা। কৃষি বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, কীটনাশক স্প্রে বিকেলের দিকে করা উচিত। না হলে সে ক্ষেত্রে মৌমাছির ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
সবশেষে সরষে ফল পেকে গেলে ঘরে তোলার পালা। সরষে গাছ সাধারণত সকালের দিকে কাটা উচিত । তা না হলে, দানা ঝরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া ফসল ভালোভাবে না পাকলে, বীজে তেলের ভাগ অনেকাংশই কমে যায়। তাছাড়া বীজের অঙ্কুর ফোটার ক্ষমতাও কমে যায়।
Leave a Reply