তাণ্ডব চালিয়ে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং চলে গেলেও ক্ষত ও ক্ষতির চিহ্নগুলো এখনও শুকায়নি। কক্সবাজারের কৃষকদের স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছে ২৫ অক্টোবর আঘাত হানা এই ঘূর্ণিঝড়। ওই সময় নোনা জলে তলিয়ে গিয়েছিল কৃষকের সোনালী ফসল। এখন সেসব ফসল জ্বলে গেছে। এতে জেলার ছয় হাজার ২২৮ কৃষকের পরিবারে নেমেছে অন্ধকার। ক্ষতি হয়েছে সাড়ে ১০ কোটি টাকা।
স্থানীয় সূত্র জানায়, গত ২৫ অক্টোবর কক্সবাজারসহ দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় আঘাত হানে সিত্রাং। এ সময় সাগরের পানি কয়েকগুণ বেড়ে যায়। জলোচ্ছ্বাসে বাঁধ ভেঙে তলিয়ে যায় ধান, শাকসবজি ও পানের বরজ। নোনা জলে তলিয়ে গিয়েছিল কৃষকের সোনালী ফসল। এখন সেসব ফসল জ্বলে গেছে ,জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানায়, সিত্রাংয়ের আঘাতে জেলার আট উপজেলার ৫১৮ হেক্টর জমির ধান, চার হেক্টর জমির শাকসবজি ও ৩২ হেক্টর পানের বরজ সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় সাড়ে ১০ কোটি। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন উখিয়া উপজেলার কৃষকরা। উখিয়ার রেজুখালের বাঁধ ভেঙে লবণাক্ত পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল ধান ও শাকসবজি। সেইসঙ্গে উপজেলার জালিয়াপালংয়ের বাইজ্যাখালী প্যারা, উত্তরপাড়া ও লম্বরীপাড়াসহ একাধিক স্থানে খালের বেড়িবাঁধ ভেঙে ফসলি জমি ডুবে যায়। ইতোমধ্যে কিছু জমির পানি নামলেও এখনও অধিকাংশ জমিতে পানি জমে আছে। মূলত নোনা জলে এসব জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
হতাশ কৃষক, দুশ্চিন্তা স্বজনদের
উখিয়ার জালিয়াপালং ইউনিয়নের লম্বরীপাড়া এলাকার কৃষি উদ্যোক্তা মীর আহমদ বলেন, ‘আমার ১০ একর জমির মধ্যে পাঁচ একর ধান ও পাঁচ একর মৎস্য খামার ছিল। খামারে প্রচুর মাছ ছিল এবং মাঠভর্তি ধান ছিল। এখন ফসল ঘরে তোলার কথা ছিল। কিন্তু নিয়তি সব কেড়ে নিয়েছে। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের আঘাতে সেদিন রাতে অস্বাভাবিক পানি বেড়ে যাওয়ায় খালের বাঁধ ভেঙে যায়। লবণাক্ত পানি ঢুকে ক্ষেতের সব ফসল নষ্ট হয়ে যায়। খামারের মাছ ভেসে যায়।’
একই কথা বললেন ওই এলাকার কৃষক আবু সৈয়দ। তিনি বলেন, ‘আমার স্বপ্নশেষ। পরিবার নিয়ে অসহায় অবস্থায় আছি। আমার সব ফসল নোনা জলে জ্বলে গেছে। কি করবো বুঝতে পারছি না। পরিবার-পরিজন নিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে। সবাই দুশ্চিন্তায় আছি। সরকারের সহযোগিতা চাই।’
উখিয়ার পশ্চিম সোনাইছড়ি গ্রামের কৃষক মোক্তার মিয়া কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার গ্রামের ৬৫ একর জমির ধান লবণাক্ত পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল। আমার একটিসহ এলাকার ২০টি মৎস্য খামারের মাছ ভেসে গেছে। এখন আমি নিঃস্ব। পানি কিছু জমি থেকে নামলেও অধিকাংশ জমিতে রয়ে গেছে। রেজুখালের বাঁধ মেরামত করে দিলে আগামীতে এলাকার মানুষ ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারবে বলে মনে করি।’
শুধু এসব কৃষক নন; তাদের মতো ওই এলাকার কৃষক সৈয়দ হোসেন, আব্দুল আলম, ফরিদ আলম, আলমগীর, আজিজ উল্লাহ, উত্তরপাড়ার মকবুল আহমদ ও গোরামিয়াসহ পাঁচ হাজার কৃষকের পরিবারে নেমেছে অন্ধকার।
জ্বলে গেছে যেসব ফসল
চলতি মাসে আমন ধান ঘরে তোলার কথা ছিল কৃষকদের। কিন্তু এসব ফসলি মাঠ এখন ঝলসে রয়েছে। মাঠের পর মাঠ আধাপাকা ধান গাছগুলো জ্বলে-পুড়ে আছে। পাশাপাশি শাকসবজি ও পানের বরজ পুড়ে গেছে।
জনপ্রতিনিধির বক্তব্য
জালিয়াপালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এসএম সৈয়দ আলম বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে উপকূলের ফসলি জমিগুলো হঠাৎ ডুবে যাবে কেউ কল্পনা করেনি। সেদিন রাতে রেজুখালের বাইজ্যাখালী প্যারা, উত্তর সোনাইছড়ি ও লম্বরীসহ পুরো এলাকা তলিয়ে যায়। এতে প্রাণহানি না হলেও জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখনও কোনও ধরনের সহায়তা পাননি কৃষকরা।’
যা বলছেন কৃষি কর্মকর্তা
কক্সবাজার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. কবির হোসাইন বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং চলে যাওয়ার পর একের পর এক ক্ষতচিহ্ন ভেসে উঠেছে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কৃষকরা। জেলার ৫১৮ একর ধান নোনা পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল। এতে ক্ষতি হয়েছে ছয় কোটি ৭৭ লাখ টাকা। এছাড়া ৪৩ একর সবজি ক্ষেত নষ্ট হয়েছে। এতে ক্ষতির পরিমাণ দুই কোটি ২০ লাখ ৯৭ হাজার। একইভাবে ক্ষতি হয়েছে পানের বরজের। প্রায় ৩২ একর জমির পান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পানের বরজের ক্ষতির পরিমাণ এক কোটি ৭৭ লাখ টাকা। সবমিলে ফসল হারিয়েছেন ছয় হাজার ২২৮ কৃষক। এখনও তাদের সহায়তা দেওয়া হয়নি।’
উখিয়া ছাড়াও রামুর খুনিয়াপালংয়ের গোয়ালিয়া, টেকনাফের বাহারছড়া, কক্সবাজার সদরের খুরুশকুল, চৌফলদন্ডী, মহেশখালী, চকরিয়া, পেকুয়া ও কুতুবদিয়া এলাকায় ধানের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সহায়তায় সরকারকে এগিয়ে আসার দাবি জানিয়েছে স্থানীয় সচেতন মহল।
সূত্রঃ বাংলা ট্রিবিউন
Leave a Reply