সাধারণত, শহরাঞ্চলই হচ্ছে বাংলাদেশের প্রধান কর্মক্ষেত্র। জীবিকার প্রয়োজনে মানুষ দলে দলে শহর মূখী হচ্ছে। বাড়ছে শহরাঞ্চলের জনসংখ্যা। বিস্তৃত হচ্ছে পরিধি। মানুষের জন্য আবাসন, অফিস, কলকারখানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাস্তা ঘাট ইত্যাদি তৈরি করার প্রয়োজনে দিনে দিনে খালি জায়গায় ভরে উঠছে অবকাঠামো। প্রয়োজনের তাগিদে মানুষ কেটে ফেলছে গাছপালা নষ্ট হচ্ছে সবুজ প্রকৃতি। খেলার মাঠ, সবুজ মাঠ, পার্ক, খোলা জায়গা পরিবর্তিত হচ্ছে ধীরে ধীরে ইট কংক্রিটের চত্বরে, প্রকৃতি হচ্ছে বিপন্ন।
এক পরিসংখানে দেখা যায় ১৯৫০ সালে ঢাকা শহরের জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৪ লক্ষ ১৭ হাজার, বর্তমানে তা দাড়িয়েছে প্রায় ১ কোটিতে এবং ২০১৫ সালে সম্ভাব্য জনসংখ্যা ২ কোটি ১১ লক্ষ। দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার ২৪ এপ্রিল ২০০৮ ‘ঢাকা তপ্ত ভূ-খন্ড হয়ে উঠছে’ আর্টিকেলে দেখা যায় গত ১০০ বছরে ঢাকা শহরের তাপমাত্রা দেশের অন্যান্য স্থানের তুলানায় দেড় গুনেরও বেশী বেড়েছে। রিপোর্টে আরো উল্লেখ করা হয় সারা দেশের গড় তাপমাত্র বৃদ্ধির হার ছিল ০.৬০ ডিগ্রি সে:, পক্ষান্তরে ঢাকার তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে ১.৮ ডিগ্রি সে:। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে ঢাকা পরিণত হচ্ছে উত্তপ্ত ভূ-খন্ডে। গাছ পালা কেটে ফেলা, জলাশয় ভরাট, যানবাহন ও কংক্রিটের স্থাপনা বেড়ে যাওয়াই এর অন্যতম কারণ। পরিণতিতে ছড়িয়ে পড়ছে নানা ধরনের রোগ ব্যাধি, পরিবেশ হচ্ছে বিপন্ন।
যে এলাকা গুলোতে গাছের আধিক্য আছে সেই এলাকার তাপমাত্রা তুলনামুলক ভাবে কম । ঢাকা শহরের গড় তাপমাত্রার চেয়ে রমনা পার্ক এলাকার তাপমাত্রা ২.০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম। অন্যদিকে কংক্রিট আবৃত মতিঝিলের তাপমাত্রা গড় তাপমাত্রার চেয়ে ২/৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশী। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নগরীর তাপমাত্র কমানোর জন্য কৃত্রিম উদ্যান স্থাপনের উদ্দ্যোগ নেয়া হয়েছে। সিংগাপুরে রাস্তার ফুটপাত গুলো সবুজ ঘাসে আবৃত করা হচ্ছে। টোকিওর মেট্রোপলিটন সরকার নতুন ছাদের ন্যুনতম ২০% জায়গায় বাগান সৃজন বাধ্যতামুলক করে ২০০১ সালে একটি আইন পাস করেছেন। যার ফলশ্রুতিতে টোকিও’র গড় তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট হ্রাস পেয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে ঢাকা শহরের প্রতিটি ছাদকে যদি ছাদ বাগান কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসা যায় তাহলে বর্তমান সমস্যা অনেকাংশেই দূর করা সম্ভব। আর এই সমস্যা দূরীকরনে সরকারকে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে হবে এবং শহর অঞ্চলের প্রতিটি ছাদকে ছাদ বাগানে পরিনত করতে উদ্বদ্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে আইন প্রয়োগ করে ছাদের একাংশ ছাদ বাগানের নির্দেশনা দিতে হবে। তবেই ছাদ বাগান শহরাঞ্চলের পরিবেশ রক্ষায় ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারবে। ছাদ বাগান কাকে বলে এর গুরুত্ব এবং ছাদে গাছ লাগানোর পদ্ধতি সহ বিভিন্ন বিষয়ে নিম্নে আলোচনা করা হলো।
ছাদ বাগান কাকে বলেঃ
সাধারণত, পাকা বাড়ির খালি ছাদে অথবা বেলকনীতে বিজ্ঞান সম্মত উপায়ে ফুল, ফল, শাক-সবজির বাগান গড়ে তোলাকে ছাদে বাগান বলা হয়। ছাদে বাগান সৃজনের সময় খেয়াল রাখতে হবে বাগান সৃজনের জন্য ছাদের কোন প্রকার ক্ষতি যেন না হয়। এজন্য রোপনকৃত গাছের টব গুলো ছাদের বীম বা কলামে নিকটবর্তী স্থান বরাবর স্থাপন করতে হবে। ড্রাম অথবা টব স্থাপনের সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন এগুলো সরাসরি ছাদের উপরে বসানো না হয়। এতে ছাদ ড্যাম্প বা সেঁতসেঁতে হয়ে যেতে পারে। তাই রিং-এর উপর বা ইটের উপর এগুলো স্থাপন করলে নিচে দিয়ে আলো বাতাস চলাচল করবে এবং ছাদও ড্যাম্প হতে রক্ষা পাবে। নেট ফিনিসিং এর মাধ্যমেও ছাদকে ড্যাম্প প্রতিরোধ করা যায়।
ছাদে বাগানের গুরুত্বঃ
(ক) তাজা শাক-সবজি ও ফল-মূল পাওয়ার জন্য;
(খ) বাড়তি আয় ও অবসর সময় কাটানোর জন্য ইত্যাদি;
(গ) কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য;
(ঘ) ছাদের সবুজ চত্বরে বিনোদনের সুবিধা পাওয়ার জন্য;
(ঙ) পরিবেশ দুষণ মুক্ত রাখার জন্য;
(চ) বায়ো ডাইভারসিটি সংরক্ষণের জন্য;
(ছ) অবকাঠামো তৈরীতে যে পরিমাণ জমি নষ্ট হয় ছাদে বাগানের মাধ্যমে তার কিছু অংশ পুষিয়ে নেওয়ার জন্য;
(জ) বৃষ্টির পানি গড়িয়ে যেতে বাধা দেওয়ার জন্য;
(ঝ) গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়ার কবল থেকে রক্ষা পাওযার জন্য;
(ঞ) ছাদের ইনসুলেশনের জন্য;
আনুষাঙ্গিক উপকরণঃ
ক) একটি খালি ছাদ;
খ) হাফ ড্রাম, সিমেন্ট বা মাটির টব, ষ্টিল বা প্লাস্টিক ট্রে বা ছাদের সুবিধা মত স্থানে স্থায়ী বেড ( ছাদ ও বেডে মাঝে ফাঁকা রাখতে হবে);
গ) সিকেচার, কোদাল, কাচি, ঝরনা, বালতি, করাত, খুরপি, সেপ্র মেশিন ইত্যাদি;
ঘ) দোঁআশ মাটি, পঁচা গোবর ও কম্পোষ্ট, বালু ও ইটের খোয়া ইত্যাদি;
ঙ) গাছের চারা/কলম বা বীজ ।
ছাদে চাষ উপযোগী গাছ পালাঃ
ক) আম- বারি আম-৩ (আম্রপালি), বাউ আম-২ (সিন্দুরী);
খ) পেয়ারা- বারি পেয়ারা-২, ইপসা পেয়ারা-১;
গ) কুল- বাউ কুল-১, ইপসা কুল-১ (আপেল কুল) , থাই কুল-২;
ঘ) লেবু- বারি লেবু -২ ও ৩, বাউ কাগজি লেবু-১;
ঙ) আমড়া- বারি আমড়া-১, বাউ আমড়া-১;
চ) করমচা- থাই করমচা;
ছ) ডালিম- (দেশী উন্নত);
জ) কমলা ও মাল্টা – বারি কমলা-১, বারি মাল্টা – ১;
ঝ) জামরুল- বাউ জামরুল-১ (নাসপাতি জামরুল), বাউ জামরুল-২ (আপেল জামরুল) ইত্যাদি।
ঞ) সবজি- লাল শাক, পালং শাক, মুলা শাক, ডাটা শাক, কলমী শাক, পুইঁশাক, লেটুস, বেগুন, টমেটো, মরিচ ইত্যাদি।
ছাদে গাছ লাগানোর পদ্ধতিঃ
ক) হাফ ড্রাম এর তলদেশে অতিরিক্ত পানি নিস্কাশনের জন্য ১ ইঞ্চি ব্যাসের ৫ / ৬ টি ছিদ্র রাখতে হবে।
খ) ছিদ্র গুলোর উপর মাটির টবের ভাঙ্গা টুকরো বসিয়ে দিতে হবে।
গ) ড্রামের তলদেশে ১ ইঞ্চি পরিমাণ ইটের খোয়া বিছিয়ে তার উপর বালি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
ঘ) সমপরিমাণ দোঁআশ মাটি ও পঁচা গোবরের মিশ্রণ দিয়ে ড্রামটির দুই তৃতীয়াংশ ভরার পর হাফ ড্রাম অনুযায়ী ড্রাম প্রতি মিশ্র সার আনুমানিক ৫০-১০০ গ্রাম প্রয়োগ করে মাটির সাথে ভাল ভাবে মিশিয়ে দিতে হবে এবং সম্পুর্ণ ড্রামটি মাটি দিযে ভর্তি করে নিতে হবে।
ঙ) ১৫ দিন পর ড্রামের ঠিক মাঝে মাটির বল পরিমাণ গর্ত করে কাংখিত গাছটি রোপন করতে হবে। এ সময় চারা গাছটির অতিরিক্ত শিকড়/ মরা শিকড় সমূহ কেটে ফেলতে হবে এবং খেয়াল রাখতে হবে মাটির বলটি যেন ভেঙ্গে না যায়।
চ) রোপিত গাছটিতে খুটি দিয়ে বেধে দিতে হবে।
ছ) রোপনের পর গাছের গোড়া ভালভাবে পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিতে হবে।
জ) সময়ে সময়ে প্রয়োজন মত গাছে পানি সেচ ও উপরি সার প্রয়োগ, বালাই দমন ব্যবস্থা নিতে হবে।
ঝ) রোপনের সময় হাফ ড্রাম প্রতি ২/৩ টি সিলভা মিক্সড ট্যাবলেট সার গাছের গোড়া হতে ৬ ইঞ্চি দুর দিয়ে মাটির ৪ ইঞ্চি গভীরে প্রয়োগ করতে হবে।
ঞ) গাছের বাড়-বাড়তি অনুযায়ী ২ বারে টব প্রতি ৫০/১০০ গ্রাম মিশ্র সার প্রয়োগ করে ভাল ভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
ট) গাছের রোগাক্রান্ত ও মরা ডালগুলো ছাটাই করতে হবে এবং কর্তিত স্থানে বোর্দ পেষ্ট লাগাতে হবে।
গাছের ডাল-পালা ছাঁটাইঃ
কুল খাওয়ার পর ফাল্গুন মাসের মাঝামাঝি গাছের সমস্ত ডাল কেঁটে দিতে হবে। তাছাড়াও অন্যান্য ফলের মরা ও রোগাক্রান্ত ডাল গুলো কেটে বোর্দ পেষ্ট লাগাতে হবে।
বালাই দমনঃ
বালাই দমনে পরিবেশ বান্ধব আইপিএম বা আইসিএম পদ্ধতি অনুসরন করতে হবে। বিশেষ প্রয়োজন ব্যতিরেকে রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার না করে জৈব রাসায়নিক বালাই নাশক যেমন- নিমবিসিডিন, বাইকাও ব্যাবহার করা যেতে পারে।
মিলি বাগঃ পেয়ারা, কুল, লেবু, আম, করমচা, জলপাই, বেগুন প্রভৃতি গাছে এ পোকার আক্রমন দেখা যায়।
লক্ষনঃ পাতার নিচে সাদা তুলার মত দেখা যায়। পোকা উড়তে পারেনা। টিপ দিলে হলুদ পানির মত বের হয়ে আসে। গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে, পাতা লাল হয়ে যায়, পাতা ও ফল ঝরে পড়ে, ফলের আকার বিকৃত হয়ে যায় অনেক সময় পাতায় শুটি মোল্ড রোগের আক্রমন হয়।
দমনঃ হাত বাছাইয়ের মাধ্যমে পোকা দমন করতে হবে। প্রয়োজনে জৈব বালাই নাশক প্রয়োগ করতে হবে।
সাদা মাছিঃ পেয়ারা, লেবু, জলপাই, বেগুন প্রভৃতি গাছে এ পোকার আক্রমন দেখা যায়।
লক্ষনঃ পাতার নিচে সাদা তুলার মত মাছি পোকা দেখা যায়। পোকা উড়তে পারে। গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে, পাতা লাল হয়ে যায়, পাতা ঝরে পড়ে, পরবর্তী মৌসুমে ফলের উৎপাদন ব্যাপক হারে হ্রাস পায়। পাতায় শুটি মোল্ড রোগের আক্রমন হয়।
দমনঃ প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হুইল পাউডার মিশিয়ে পাতার নিচে সেপ্র করলে ভাল ফল পাওয়া যায়।
শুটি মোল্ডঃ ছত্রাক দ্বারা সংগঠিত হয়। পাতার ওপর কালো কালো পাউডার দেখা দেয়। গাছের ফলন ব্যহত হয়। আক্রমণ ব্যাপক হলে পাতা ও ফল ঝরে যায়।
দমনঃ টিল্ট-২৫০ ইসি, প্রতি লিটার পানিতে ০.৫০ মিঃলিঃ মিশিয়ে সেপ্র করতে হবে।
তথ্যসূত্রঃ কৃষিবাংলা ডট কম
Leave a Reply