পাবনার বেড়া ও সাঁথিয়া উপজেলায় এবার পেঁয়াজের ফলন কম হয়েছে। খেতে পেঁয়াজগাছের মাথা শুকিয়ে যাওয়ায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এতে কোনো কোনো কৃষক গত মৌসুমের তুলনায় পেঁয়াজের ফলন অর্ধেকেরও কম পাচ্ছেন। এক দিকে ফলন কম, আরেক দিকে বাজারে পেঁয়াজের দাম না পাওয়ায় চাষিরা লোকসানে পড়েছেন।
কয়েকজন চাষি বলেন, অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত হয়ে পেঁয়াজগাছের মাথা শুকিয়ে যাওয়ায় ফলন কম হয়েছে। কৃষি বিভাগও পেঁয়াজগাছের এই রোগ সম্পর্কে তেমন কিছু জানাতে পারেনি। এ সম্পর্কে বেড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নূর-এ আলম বলেন, ‘মৌসুমের শুরুতে যেসব কৃষক পেঁয়াজ আবাদ করেছিলেন, তাঁদের খেতে এই সমস্যা ছিল না। কিন্তু যাঁরা দেরিতে আবাদ করেছেন, তাঁদের খেতে এ ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছে। এবারই এ ধরনের সমস্যা প্রথম দেখা দেওয়ায় এর সঠিক কারণ আমরা এখনো বের করতে পারিনি। তবে এই বিষয় নিয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
পেঁয়াজ চাষের দুটি পদ্ধতি রয়েছে। একটি হলো আগাম বা মূলকাটা ও অন্যটি হলো হালি। মূলকাটা পদ্ধতিতে অক্টোবর-নভেম্বরে আবাদ করে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে পেঁয়াজ ঘরে তোলা হয়। অন্যদিকে হালি পদ্ধতিতে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে পেঁয়াজের আবাদ করে মার্চ-এপ্রিলে পেঁয়াজ ঘরে তোলা হয়। এই পদ্ধতিতেই সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজের আবাদ হয়ে থাকে। এখন হালি পদ্ধতির পেঁয়াজ তোলার মৌসুম চলছে।
যাঁরা দেরিতে আবাদ করেছেন, তাঁদের খেতের পেঁয়াজগাছের মাথা শুকিয়ে গেছে। ফলন কম হয়েছে।
উপজেলা কৃষি কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, সাঁথিয়া উপজেলায় এবার ১৬ হাজার ৭৫০ হেক্টর জমিতে ও বেড়ায় ৫ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের আবাদ হয়েছে। দুই উপজেলায় দুই-তিন সপ্তাহ ধরে হালি জাতের পেঁয়াজ বাজারে উঠছে। আগাম জাতের পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা যায় না। সারা বছরের চাহিদা পূরণ করে হালি পেঁয়াজ।
চাষিরা জানান, এবার আগাম জাতের পেঁয়াজের ফলন ভালো হলেও দাম কম ছিল। তাঁরা আশায় ছিলেন, হালি পেঁয়াজের হয়তো ভালো দাম পাবেন। কিন্তু হালি পেঁয়াজের ভালো দাম তো মিলছেই না বরং পেঁয়াজখেত অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত হওয়ায় ফলন অনেক কম হয়েছে। লোকসানের পাল্লা আরও ভারী হয়েছে তাঁদের।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এবার সার, কীটনাশক, মজুরিসহ সব খরচ মিলিয়ে ১ বিঘায় উৎপাদন খরচ পড়েছে ৫০ থেকে ৫৫ হাজার টাকা। আগের বছরগুলোয় প্রতি বিঘায় ফলন পেয়েছেন ৫০ থেকে ৬০ মণ পেঁয়াজ। কিন্তু পেঁয়াজখেতের অজ্ঞাত রোগ ও অসময়ের শিলাবৃষ্টিতে অনেক কৃষকই এবার বিঘায় ২৫ থেকে ৩০ মণ ফলন পেয়েছেন। তবে যাঁরা মৌসুমের শুরুতে পেঁয়াজের আবাদ করেছিলেন, তাঁরা ভালো ফলন পেয়েছেন।
বাজারে এখন প্রতিমণ পেঁয়াজ পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে ৯০০ থেকে ১ হাজার ১০০ টাকায়। এই দামে পেঁয়াজ বিক্রি করে বিঘায় অন্তত ২৫ হাজার টাকা লোকসান হচ্ছে। তবে যেসব কৃষকের ফলন ভালো হয়েছে, তাঁদের লোকসান তুলনামূলক কম।
সরেজমিন বেড়া উপজেলার বড়শিলা, চাকলা, নলভাঙা ও সাঁথিয়া উপজেলার বায়া, করমজা, পুণ্ডুরিয়া গ্রামের ফসলের জমি ঘুরে দেখা যায়, কৃষকেরা পরিবারের লোকজনসহ মজুর নিয়ে পেঁয়াজ তুলছেন। বেশির ভাগ পেঁয়াজখেতের গাছগুলোর মাথার দিকের অংশ শুকিয়ে গেছে। পেঁয়াজের আকারও হয়েছে বেশ ছোট।
বেড়া উপজেলার বড়শিলা গ্রামের ফসলের মাঠে লোকজন নিয়ে পেঁয়াজ তুলছিলেন শাহজাহান ব্যাপারী। তিনি বলেন, ‘দুই বিঘা জমিতে পেঁয়াজের আবাদ করতি লাখ টাকার ওপর খরচ হইছে। গতবার বিঘায় ৬০ মণের মতো ফলন পাইছিলাম। অথচ এবার ২ বিঘায় ৫০ মণ ফলন পাব কি না, সন্দেহ আছে। বাজারে এই দামে পেঁয়াজ বেইচ্যা খরচের অর্ধেকও উঠবি না।’
সাঁথিয়া উপজেলার বায়া গ্রামের সিরাজুল ইসলাম ভ্যানে বাড়িতে পেঁয়াজ আনার পর কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘দেড় বিঘা জমিতে এবার মাত্র ৩৫ মণ পেঁয়াজ পাইল্যাম। অথচ ৮০ থেকে ৯০ মণ পেঁয়াজ পাওয়ার কথা। বাজারে পেঁয়াজের দামও নাই। এবার পেঁয়াজের আবাদ কইর্যা শ্যাষ হয়া গেলাম।’
বেড়ার বড়শিলা গ্রামের শাহীনুর ইসলাম, আফজাল হোসেন, শাহজাহান ব্যাপারী, চাকলা গ্রামের চাঁদ আলী; সাঁথিয়া উপজেলার বায়া গ্রামের আল মাহমুদ হোসেন, শাহজাহান ব্যাপারীসহ ১০ থেকে ১২ জন পেঁয়াজচাষি বলেন, আবাদের শুরুতে পেঁয়াজের খেতে কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু গাছগুলো বড় হতেই এর মাথা মরে যেতে শুরু করে। একপর্যায়ে গাছগুলো সজীবতা হারিয়ে অনেকটাই নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে। স্থানীয় কৃষি কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের জানালেও তাঁরা এ ব্যাপারে সমাধান দিতে পারেননি।
সূত্র : প্রথম আলো
Leave a Reply