গাইবান্ধার ফুলছড়ির ব্রহ্মপুত্র নদসংলগ্ন ফুলছড়ি হাট। ভোর থেকে নৌকা, ঘোড়ার গাড়ি, ভ্যান অথবা মাথায় করে মরিচ নিয়ে হাটে আসছেন কৃষক ও ব্যাপারীরা। বেলা বাড়ার সঙ্গে ক্রেতা–বিক্রেতার ছোটাছুটি ও ব্যস্ততা বাড়ছে। সম্প্রতি হাটে গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা গেল।
সপ্তাহের প্রতি শনি ও মঙ্গলবার বসে ফুলছড়ি হাট। গাইবান্ধা সদর, ফুলছড়ি, সাঘাটা ও বগুড়ার সারিয়াকান্দির চরাঞ্চল এবং জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের কয়েকটি চর থেকে কৃষকেরা মরিচ বেচতে আসেন এই হাটে। এই অঞ্চলে ফুলছড়ি হাট মরিচের বাজার হিসেবে বেশ প্রসিদ্ধ। প্রতি হাটে কোটি টাকার ওপর মরিচ কেনাবেচা হয়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছর জেলার ৭ উপজেলায় ২ হাজার ৩০ হেক্টর জমিতে মরিচের চাষাবাদ হয়েছে। এর মধ্যে শুধু ফুলছড়িতে ৯৯২ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে। জেলায় এ বছর মোট ৫ হাজার ৭৫ মেট্রিক টন শুকনা মরিচ উৎপাদিত হয়েছে।
এই প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকদের গুণগত মানের বীজসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করা হচ্ছে। মরিচ শুকানো ও সংরক্ষণে আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় চর এলাকার উৎপাদিত ফসল সংরক্ষণে ফুলছড়ি মরিচের হাটসংলগ্ন জায়গায় শস্য সংরক্ষণাগার করা হয়েছে।
কৃষকের মুখে হাসি
১৫ এপ্রিল হাটে গিয়ে দেখা যায়, সারি সারি বস্তায় লাল মরিচ নিয়ে বসেছেন কৃষক ব্যাপারীরা। কেনাবেচায় ব্যস্ত সবাই।
হাটে সাঘাটার দিগলকান্দির কৃষক জাহেদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, দুই বিঘা জমিতে মরিচের চাষ করেছেন। ইতিমধ্যে ৮০ হাজার টাকায় ২০ মণ কাঁচা মরিচ বিক্রি করেছেন। শুকিয়ে লাল মরিচ পেয়েছেন ১৫ মণ। প্রতি মণ ১৭ হাজার টাকা দরে ২ লাখ ৫৫ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন।
জাহেদুলের হিসাবে, বিঘাপ্রতি মরিচ চাষাবাদে তাঁর ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। মরিচ চাষে এবার তিনি ভালো লাভ পেয়েছেন।
জানা গেছে, ফুলছড়ি উপজেলার এরেন্ডাবাড়ি, ফজলুপুর, ফুলছড়ি, উড়িয়া, গজারিয়া, সাঘাটার হলদিয়া, সদর উপজেলার কামারজানি, বগুড়ার সারিয়াকান্দির সানন্দবাড়ী ও জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের চরাঞ্চলের কৃষক ও ব্যাপারীরা মরিচ বেচতে এই হাটে আসেন।
হাটে অন্তত ১৫ জন কৃষকের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁরা বলেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার শুকনা মরিচের দাম ভালো।
মরিচ বেচে বাড়ি ফিরছিলেন বালিয়াকান্দির সেকেন্দার আলী। তিনি বলেন, গত বছর তিনি শুকনা মরিচ বেচেছেন পাঁচ হাজার টাকা মণ। এবার বেচলেন ১৭ হাজার ৬০০ টাকা করে।
সেকেন্দার বলেন, তাঁর এক বিঘা জমিতে ১২ মণ মরিচ হয়েছে। শুকনা মরিচ বেচেছেন ২ লাখ টাকার বেশি। খরচ হয়েছে ৭০ হাজার। লাভের টাকায় একটি গরু কিনেছেন। সংসারের খরচ মেটাচ্ছেন।
চরের মরিচের চাহিদা বেশি কেন
দেশব্যাপী চরাঞ্চলের মরিচের চাহিদা বেশি কেন? এমন প্রশ্নে উপজেলা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আবু হাসান বলেন, মাটির গুণাগুণ ও আবহাওয়ার কারণে চরাঞ্চলের মরিচের রং সুন্দর ও আকার বড় হয়।
বগুড়া, নওগাঁ, রংপুরসহ বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীরা ফুলছড়ি হাটে মরিচ কিনতে আসেন। তবে বেশি মরিচ কেনেন ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী নামীদামি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা।
স্বপন আলী বগুড়ার সারিয়াকান্দি থেকে এই হাটে মরিচ কিনতে এসেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এখান থেকে মরিচ কিনে প্রাণ, স্কয়ারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করেন।
স্থায়ী জায়গা নেই, টোল বেশি
ইজারাদারসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাটের নিজস্ব কোনো জায়গা নেই। ইজারাদারেরা জায়গা ভাড়া নিয়ে হাট চালান। তাই দূরের ক্রেতা–বিক্রেতারা হাটে এলে খানিকটা সমস্যা পড়েন।
ফুলছড়ি উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, হাটে দূর–দূরান্তের ক্রেতা–বিক্রেতাদের থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই। তাঁদের থাকার সুব্যবস্থা করতে পারলে ব্যবসা–বাণিজ্য আরও বাড়ত।
ইজারাদার সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর ইজারা বাবদ আয়কর ও ভ্যাট মিলে সরকার প্রায় কোটি টাকা রাজস্ব পেয়েছে। তবে কৃষকদের অভিযোগ, ইজাদারেরা তাঁদের কাছ থেকে সরকারি হারের চেয়ে বেশি টোল নিচ্ছেন।
খাটিয়ামারীর কৃষক শাহ আলী সরকার বলেন, এক মণ মরিচ বেচলে আধা কেজি মরিচ বা ২০০ টাকা খাজনা দিতে হয়।
তবে ইজারাদার নুরুল আমিনের দাবি, আগের ইজারাদার বাড়তি টোল নিতে পারেন। তাঁরা সরকারি নিয়ম মেনে টোল আদায় করেন।
চরের মরিচ ঘিরে সম্ভাবনা
গাইবান্ধার চরাঞ্চলের কৃষি নিয়ে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। চরাঞ্চলে ‘মেকিং মার্কেটস ওয়ার্ক ফর দ্য চর’ (এমফোরসি দ্বিতীয় পর্যায়) প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকদের ধান, ভুট্টা, পাট, মরিচসহ শস্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও টেকসই উন্নয়নে কাজ করছে পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (আরডিএ) বগুড়া।
এমফোরসি প্রকল্প পরিচালক আবদুল মজিদ প্রথম আলোকে বলেন, এই প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকদের গুণগত মানের বীজসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করা হচ্ছে। মরিচ শুকানো ও সংরক্ষণে আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় চর এলাকার উৎপাদিত ফসল সংরক্ষণে ফুলছড়ি মরিচের হাটসংলগ্ন জায়গায় শস্য সংরক্ষণাগার করা হয়েছে।
সূত্র : প্রথম আলো
Leave a Reply